Logo

মতামত

গৌরবের ৩৬ জুলাই

মিরাজুল ইসলাম

মিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৪২

গৌরবের ৩৬ জুলাই

৩৬ জুলাই-বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য, রক্তাক্ত গৌরবের দিন। এই দিন শুধু একটি সরকারের পতনের স্মারক নয়, বরং এটি একটি জাতির জাগরণের দিন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের লড়াইয়ের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। এই দিনে শেখ হাসিনার ১৭ বছরের একদলীয় কর্তৃত্বের পতন ঘটে, যার সূচনা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে; আর বিস্তার ঘটে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায়।

ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ দাবি ছিল খুবই স্পষ্ট, বিচারসঙ্গতভাবে কোটা সংস্কার। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন, হামলা ও হয়রানি আন্দোলনটিকে ‘দাবি’ থেকে ‘অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’-এ রূপ দেয়। গণগ্রেপ্তার, র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান, রাতের অন্ধকারে শিক্ষার্থীদের তুলে নেওয়া, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে গুলি চালানো— এসবই মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, এ আর কেবল কোটার বিষয় নয়, এটি একটি বৃহত্তর দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার সময়।

এভাবেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, সাধারণ মানুষ, দিনমজুর, চাকরিজীবী, এমনকি পেশাজীবীদের একটি বড় অংশও এতে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

এই বিপ্লব রাজনীতির অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দি, নিশ্চুপ, কিংবা ছায়ার নিচে থাকা অনেক সংগঠন উঠে আসে সক্রিয় নেতৃত্বে।

বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যা গড়ে ওঠে ছাত্র-জনতার সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম থেকে, তারাই আন্দোলনের ফ্রন্টলাইন নেতৃত্বে চলে আসে।

এছাড়াও গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্র ফেডারেশন, বিচারপন্থী ছাত্র ঐক্য, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল কিছু বাম সংগঠনও মাঠে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

আওয়ামী লীগের পক্ষে তখনকার সময় কার্যত কেউ মাঠে ছিল না-শুধু প্রশাসনিক বলপ্রয়োগই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। ফলে জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।

৩৬ জুলাইয়ের দুপুর পর্যন্ত শেখ হাসিনা প্রশাসন ব্যস্ত ছিল কঠোর নিরাপত্তা ও বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ অবস্থানে যাওয়ার পর যখন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণের ঘোষণা দেন— পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। জনতা বুঝে নেয়, এখনই সময়।

বেলা আড়াইটার দিকে নিশ্চিত হওয়া যায়, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন।

এই দৃশ্য শুধু একটি সরকারের প্রধানের প্রস্থান নয়, বরং একটি যুগের, একটি নিপীড়নের, একটি অবিচারের সমাপ্তি।

এই দিনই গণভবনে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন সাধারণ ছাত্ররা। পুরো গণভবন তখন হয়ে ওঠে জনগণের মিলনমেলা। কাঁদে মানুষ, হাসে মানুষ— এক সঙ্গে স্বস্তি ও স্মৃতির আবেগ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। রক্ত দিয়ে কেনা সেই বিজয় স্মরণ করিয়ে দেয়— অন্যায় যতই দীর্ঘ হোক, তার পতন অনিবার্য।

এই বিজয়ের মূলে আছে শত শত শহীদের আত্মত্যাগ, অগণিত আহত মানুষের কষ্ট, আর অসংখ্য পরিবারের কান্না। এই আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠছে— তা যেন শুধু একটি পরিবর্তনের গল্প না হয়ে ওঠে, বরং একটি ন্যায্যতা ও সাম্যের সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি হয়।

বর্তমান অস্থায়ী সরকার নতুন সংবিধান, গণতন্ত্রের ভিত্তি পুনর্গঠন এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অবশ্যই সময়োপযোগী। কিন্তু শুধু নীতি বা নোটিশ নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের সঙ্গে বাস্তব সংযোগ।

৩৬ জুলাই তাই শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশকও। এই দিন মনে করিয়ে দেয়— ইতিহাস গড়ে ওঠে প্রতিবাদে, বিজয় আসে ঐক্যে, আর দেশ বদলায় মানুষের জেগে ওঠায়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর