-68959a78534e7.jpg)
চব্বিশের বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠ উন্মুক্ত হয়েছে। সকল মত ও পথের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারছে। কেউ কেউ আবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে নিজের করে নিতে ন্যারেটিভ তৈরি করতে প্রপাগান্ডা ও নানা কৌশল-অপকৌশল কিংবা প্রচারণায় সরব হয়েছেন। নীতির রাজনীতির পরিবর্তে বিবর্জিত রাজনীতির সংস্কৃতিকে তুলে আনছেন— যা গণঅভ্যুত্থানের কবর দেওয়ার কথা।
আমি আগের একটি লেখায় বলেছিলাম ২৪ এর জুলাই আন্দোলনে নানা পক্ষ বা স্টেকহোল্ডাররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন। সকলের আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বৈরাচারের বিদায় ও মুক্ত দেশের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। তবে রাজনীতিতে শূন্যতা থাকা উচিত নয়, এর মানে এই নয়, যাকে বিলোপ করতে হাজার হাজার মানুষ শহীদ ও পঙ্গুত্বা বরণ এবং আহত হলেন তার কোনো রূপের উপস্থিতিতে সহযোগিতা করা বা ভূমিকা রাখা কিংবা সেই রূপটি ধারণ করা। যদি তা হয় তাহলে আরেকটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত হবে না।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের এক বছরপূর্তি উপলক্ষে এটির স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থা বর্ণিল আয়োজনে উদযাপন করেছে। সরকারও জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নানা অনুষ্ঠান ও পরিবেশনার আয়োজন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জুলাই ঘোষণাপত্র পেশ করেছেন লাখো জনতার উপস্থিতিতে। এসবের মূলেই মূলত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্য প্রতিফলিত হয়। যেখানে নিজ নিজমতাদর্শ কার্যত নিজ নিজ বলয়ে রেখে জাতীয় একটি স্বার্থে সবাই এগিয়ে এসেছেন। এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
তবে এমন ঐক্যবদ্ধ জাতির মধ্যেও বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে কিছু গোষ্ঠী ক্ষুদ্র স্বার্থকে উদ্ধারে উঠেপড়ে লেগেছে। হীন কাজ নেই যা করছে না-যা কিনা স্বৈরাচার আমলে অনুশীলন করা হতো। বেশ কয়েকটি ঘটনার পর্যালোচনায় এসব উঠে আসছে। যা আলোচনায় ক্রমান্বয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এসব ন্যারেটিভের সমাধান করতে ব্যর্থ হলে আবার বিভেদ দানা বাধবে, রাজনীতির সংস্কার দুরূহ হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের এখন ক্রিয়াশীল বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। অপরদিকে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল। এর বাইরে বাম কিছু সংগঠন রয়েছে যেগুলোও কাজ করছে ক্ষুদ্র পরিসরে, তবে তারা সংখ্যার চেয়ে ভোকাল ও প্রচারণায় থাকে। জুলাই অভ্যুত্থান উদযাপনের অংশ হিসেবে ছাত্রশিবির বেশ কিছু আয়োজন করেছে, যা অন্যকোনো ছাত্রসংগঠন তাদের মতো করে জমকালো আয়োজন করেনি। সংগঠনটির বিভিন্ন ইউনিট নানা আয়োজন করলেও রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাইমুমের আয়োজনটি ছিল সবচেয়ে নজরকাড়া। যা উদ্বোধন করেছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। তাদের আয়োজনে জুলাই অভ্যুত্থানকে জীবন্ত করে তোলা হয়েছিল নানা রকম ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এতে স্থান পেয়েছিল ফ্যাসিবাদের তৈরি গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ ও ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর গণভবন।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল ঢাবি শিবির। এছাড়া ৫ আগস্ট সকালে সাইকেল র্যালিরও আয়োজন করেছিল সংগঠনটি। তবে বিপত্তি বাধে টিএসসির প্রদর্শনী নিয়ে। জুলাই অভ্যুত্থানের নানা বিষয়সহয় ফ্যাসিবাদী আমলের নানা অপকর্ম তুলে ধরা হয় এই প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে একটি বিষয়- ফ্যাসিবাদী আমলে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের প্রদর্শনী নিয়ে আপত্তি তোলে বাম কয়েকটি সংগঠন। যেখানে বিএনপি ও জামায়াতের সাবেক শীর্ষ নেতাদের বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে উল্লেখ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। তার জীবন্ত উদাহরণ হলো জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম একই ধরনের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি আদালতের রায়ের মাধ্যমে চলতি বছরের ২৭ মে খালাস পেয়েছেন। তবে ঢাবি শিবির প্রদর্শনী নিয়ে বাম সংগঠনগুলোর বিতর্ক বা মব সৃষ্টির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্টরের অনুরোধে জামায়াত ও বিএনপির নেতাদের ছবি সরিয়ে নেয়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, যে স্বৈরাচারী আমলের ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আদালতে চলাকালে শাহবাগে বামপন্থী সংগঠনগুলো আন্দোলন করে আদালতের উপর প্রভাব বিস্তার করে রায়কে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বাস্তবতা হলো জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার সাজা যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড করে তা কার্যকর করা হয়েছে। সেই একই আদর্শের সংগঠন এখন এই ইস্যুতে সোচ্চার বলে দাবি করেছে ছাত্রশিবির। গতকাল ঢাবি শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন বিচারের নামে সংঘটিত এই ফাঁসিগুলো বিচার নয়— রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড এবং এই হত্যাকাণ্ডের দায় শুধু হাসিনা সরকার নয়, শাহবাগপন্থী সুবিধাভোগী বামপন্থীরাও এ দায় এড়াতে পারে না। ফ্যাসিবাদ পতনের এক বছরের মাথায় ফ্যাসিবাদের দোসরদের ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড ও বয়ানের পুনরুৎপাদন জুলাইয়ের স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক। একই সাথে, জনবিচ্ছিন্ন চিহ্নিত বামপন্থি গোষ্ঠীকে কিছু গণমাধ্যমে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে যা সম্পূর্ণ অসত্য বলেও দাবি করেন তিনি।
গতকালের ঢাবির ঘটনায় শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সাদিক কায়েমকে পাকিস্তানি বলে স্লোগান দিয়ে ভুল স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু। তবে এটি রাজনৈতিক শিষ্টাচার হলেও তাদের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির সূত্র অপরিবর্তিতই রয়েছে। বিচারিক হত্যাকাণ্ডের যে প্রসঙ্গটি এসেছে প্রদর্শনীকে ঘিরে সেই জায়গায় জামায়াতের এখন দায় দাঁড়িয়েছে আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করা হত্যাকাণ্ডের শিকাররা নির্দোষ ছিলেন এটিএম আজহারের মতোই। মরণোত্তর হলেও সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে যেন ঘোষণা আসে— তারা নির্দোষ ছিলেন। নইলে রাজনৈতিক বিতর্কে কুলুপ এঁটে দেওয়া দলটির জন্য সহজ হবে না। কারণ, ফ্যাসিস্ট আমলে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিতর্কিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। খোদ বিএনপির চেয়ারপারসন, দলটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
দৃশ্যত, বাংলাদেশের রাজনীতির লড়াইটা আদর্শের ও স্বার্থের। সেই জায়গায় কেউ ছাড় দেবে না। তবে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার ক্যাম্পাসগুলোতে বিভিন্ন সংগঠনের যে সহাবস্থান তা বজায় রাখারও গুরুদায়িত্বও রয়েছে অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারদের। তবে তা যদি ধরে রাখা না হয় এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সুষ্ঠু পরিবেশ ধ্বংস করা হয়— তাহলে ফ্যাসিবাদের নতুন রূপ আবির্ভূত হতে পারে। যাতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, নিপীড়নমুক্ত হলগুলোতে আবারও নির্যাতনের সূচনা হতে পারে। রাজনীতিতে আদর্শের লড়াই যেমন থাকবে, তেমনি স্বার্থের লড়াইও থাকবে। তবে, তা যেন জনআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি না হয়—চব্বিশের অভ্যুত্থানবিরোধী না হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com