Logo

মতামত

৫০ বছর পরও জাতির হৃদয়ে অমলিন ১৫ আগস্টের ক্ষত

Icon

ফারজানা জিতু

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫:০২

৫০ বছর পরও জাতির হৃদয়ে অমলিন ১৫ আগস্টের ক্ষত

এআই দিয়ে তৈরি ছবি

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু একটি সাধারণ তারিখ নয়, এটি এক জাতির হৃদয়ে লেগে থাকা এক অমলিন ক্ষতচিহ্ন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে। এ ঘটনাটি কেবল একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটি ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি এক নিষ্ঠুর আঘাত, যা জাতির চলমান গণতান্ত্রিক যাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল রাজনৈতিক অপশক্তির উত্থানের দিন। ওরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে হত্যা করতে। এর পর শুরু করেছিল ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা। শিক্ষা, পাঠ্যক্রম, গণমাধ্যম, প্রশাসন— সবখানেই ইতিহাস বিকৃতি চলতে থাকে। 

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ অন্ধকার সময়ের চক্রে আটকে গিয়েছিল দেশ। এ সময় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি তাঁকে সপরিবারে হত্যার বিচার করা যাবে না বলে জারি করা হয়েছিল ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়, জাতি মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকসভা, দোয়া-মোনাজাত এবং শোকর‌্যালির মাধ্যমে দিনটি পালন করে। তবে এই দিবসটির গুরুত্ব রাজনৈতিক কারণে বারবার ভিন্নরকম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি শাসনের সময় ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই দিনটি সরকারি ছুটি ছিল না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে তা পুনঃস্থাপন করে।

২০২৪ সালে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, তারা এই দিবসের সরকারি স্বীকৃতি বাতিল করে। সরকার এই সিদ্ধান্তকে ‘রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা’ হিসেবে তুলে ধরলেও আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো এটিকে ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখছে। গত এক বছরে দেশে আবার পুরনো সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর আঘাত আসছে ক্রমাগত। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ভেঙে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা আবারও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে একরকম। তবু মানুষের মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলা যায়নি। 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৫০তম বার্ষিকী এবার। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কিছু দলীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কালো পতাকা উত্তোলন, প্রার্থনার মতো নিভৃত কর্মসূচির মাধ্যমে জাতি এ বেদনাকে স্মরণ করছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকের দিন হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে একে বিতর্কিত করা হয়েছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে ‘জাতীয় শোক দিবস’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। কিন্তু কেউ কেউ আবার একে ক্ষমতার রাজনীতির অংশ বলে চিহ্নিত করতে চান।

তবে ইতিহাসের সত্য অস্বীকার করা যায় না— বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের অনিবার্য অংশ। পঞ্চাশ বছর পরও এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতার অর্জন রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং বিভাজন নয়, ঐক্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি শুধু এক ব্যক্তির কাহিনি নয়, এটি একটি জাতির মুক্তি ও সম্মানের চিত্র, যা চির অবিচ্ছেদ্য।

আজ ১৫ আগস্ট সরকারি ছুটি না হলেও জাতির স্মৃতি ও শোকের প্রতীক হিসেবে এর মর্যাদা অটুট রয়েছে মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেকোনো একজন নেতা নযন, তিনি বাঙালির স্বপ্ন ও স্বাধীনতার প্রতীক, স্বাধীনত বাংলাদেশের স্থপতি। পঞ্চাশ বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর নাম, চেতনা এবং আদর্শ জাতির হৃদয়ে অমলিন। তাঁর দেখানো পথ, সংগ্রাম এবং দর্শন দেশের নাগরিকদের জন্য চিরন্তন প্রেরণা। হত্যাকারীরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব শেষ করতে। তারা হয়ত জানতো না, সত্য, ন্যায় এবং মানুষের বিশ্বাস কখনও মারা যায় না।

তাই আজকের দিনে আমরা শোক করি, স্মরণ করি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— প্রতিজ্ঞা করি সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার; বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের, আদর্শের সোনার বাংলা গড়তে সাধ্যমতো কাজ করে যাওয়ার। 

লেখক : হস্তশিল্প উদ্যোক্তা; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শিল্পপুরাণ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর