Logo

মতামত

কাশ্মীর : এক নিষিদ্ধ বইয়ের গল্প

Icon

অনুরাধা ভাসিন

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৪

কাশ্মীর : এক নিষিদ্ধ বইয়ের গল্প

ভারত কেন একটি বইকে ভয় পায়? কেন রাষ্ট্র তার বিশাল সামরিক শক্তি, কঠোর আইন ও প্রচারণার মধ্যেও একটি শব্দের সামনে কেঁপে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় ২০১৯ সালের ৫ আগস্টে।

সেদিন ভারত সরকার হঠাৎ করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে নেয়। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে রাজ্যটিকে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে দিল। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকে এই উপত্যকার ইতিহাস নতুন মোড়ে গড়ায়।

ওই ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকী ঘিরে যখন গুজব, আতঙ্ক আর অস্বাভাবিক তৎপরতা বাড়ছিল, তখনই আসে নতুন আঘাত। ভারত সরকার নিষিদ্ধ করল জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে লেখা ২৫টি বই। অভিযোগ— ওগুলো নাকি ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছড়ায়, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’কে উসকে দেয়।

তালিকায় আমার বইও আছে— ‘এ ডিসম্যান্টলড স্টেট : দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ কাশ্মির আফটার আর্টিকেল ৩৭০’। হার্পারকলিন্স থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বইটি আসলে ছিল এক বিরল দলিল— ২০১৯–এর পর জম্মু ও কাশ্মীরবাসীর দৈনন্দিন বাস্তবতা, যা সরকারি দাবি করা ‘স্বাভাবিকতা’র বিপরীত ছবি তুলে ধরে।

সরকার বলেছিল, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল মানেই শান্তি, উন্নয়ন আর স্বাভাবিকতার সূচনা। কিন্তু বাস্তবতা কেমন ছিল?

  • তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীসহ হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার।
  • গোটা উপত্যকা কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা কারফিউ জোনে পরিণত।
  • ইন্টারনেট, টেলিফোন সব বিচ্ছিন্ন।

সাংবাদিকতা দমিয়ে রাখা হলো-যেসব সংবাদপত্র সরকারকে প্রশ্ন করতে চাইল না, তাদের বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দেওয়া হলো। যারা প্রশ্ন তুলল, তারা টিকে থাকতে পারল না।

কিছুদিন পর সীমিতভাবে ইন্টারনেট চালু হলেও দমননীতি আরও কঠোর হলো। জননিরাপত্তা আইনের (PSA) আওতায় বিনা অভিযোগে দীর্ঘমেয়াদি আটক বেড়ে গেল। সাংবাদিক, কর্মী, মানবাধিকার রক্ষাকারী— কেউ রেহাই পেলেন না।

এই শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়েই আমি বইটি লিখেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল নগ্ন সত্য তুলে ধরা। সত্য, যা সরকার লুকাতে চায়।

গত ছয় বছরে আমি দেখেছি— ভারতীয় রাষ্ট্র সমালোচনার প্রতি ভীষণ অসহিষ্ণু। প্রশ্ন তুললেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা : জিজ্ঞাসাবাদ, যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত, আয়কর মামলা, কখনও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ, কখনও দীর্ঘ আটক।

তথ্যের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, বইয়ের মতো দলিলই সেই ফাঁক পূরণ করছিল। তাই ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা হলো— যেন বিকল্প আখ্যানের অস্তিত্বই মুছে দেওয়া যায়।

কিন্তু রাষ্ট্র জানে না, নিষেধাজ্ঞা সত্যকে চাপা দিতে পারে না। বরং নিষিদ্ধ করাই বইগুলোর প্রাসঙ্গিকতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল ২৬ নিরীহ বেসামরিক হত্যাকাণ্ড সেই সরকারি বুদবুদ ভেঙে দিয়েছিল। তদন্তকারীরা বলেছিলেন, এতে স্থানীয় নয়, বিদেশি জঙ্গিরা জড়িত। কিন্তু সরকার সেই সুযোগে আরও কঠোর হলো। অভিযান বাড়ল, ঘরবাড়ি ভাঙল, আটক হলো অসংখ্য মানুষ।

এই প্রেক্ষাপটে ২৫টি বই নিষিদ্ধ করা কাকতালীয় নয়। এটি সেই একই নিয়ন্ত্রণনীতিরই সম্প্রসারণ। সরকার এখন চায় কাশ্মীরের গল্প কেবল তার নিজের মুখেই শোনা যাক।

রাষ্ট্রীয় সংস্করণ ছাড়া অন্য কোনো স্মৃতি, আখ্যান বা দলিল বেঁচে থাকতে পারবে না। লিখিত শব্দকে অপরাধী ঘোষণা করা হচ্ছে। এমনকি পড়াকেও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলা হচ্ছে।

গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন-স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তরুণদের হাতে পাথর দিয়েছিল, আর তিনি দিয়েছেন বই ও ল্যাপটপ।

কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো— অভিযানে বাজেয়াপ্ত হয় ল্যাপটপ, নিষিদ্ধ হয় বই। একে কীভাবে ‘স্বাভাবিকতা’ বলা যায়?

কাশ্মীর আজ এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি। সরকার যে উন্নয়ন আর শান্তির গল্প শোনায়, তা ভিন্ন বাস্তবতায় প্রতিদিন ভেঙে পড়ে। নিষিদ্ধ বইগুলো আসলে রাষ্ট্রের ভয়ের দলিল- ভয় যে সত্যি চাপা পড়ে না, বিকল্প আখ্যান টিকে থাকে।

আমার বই যদি রাষ্ট্রকে ভীত করে, তবে সেটাই প্রমাণ করে— কাশ্মীর এখনো স্বাভাবিক হয়নি। সত্য এখনো অদম্য।

অনুরাধা ভাসিন : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দ্য কাশ্মির টাইমস

কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার মতামত বিভাগে ১২ আগস্ট ২০২৫ প্রকাশিত লেখাটি বাংলাদেশের খবরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আরিফুল ইসলাম সাব্বির। 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

কাশ্মীর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর