Logo

মতামত

হাজরা বেগমের বিপ্লবী জীবন

Icon

কামরান আসদার আলী

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫৯

হাজরা বেগমের বিপ্লবী জীবন

হাজরা বেগম। ছবি : সংগৃহীত

১৯১০ সালে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাজরা মুমতাজউল্লাহ খান-যিনি পরবর্তী সময়ে পরিচিত হন হাজরা বেগম নামে। জন্মেছিলেন এক অভিজাত পরিবারে; বাবা মমতাজউল্লাহ খান ছিলেন রাজস্ব কর্মকর্তা, মা নাতিকা বেগমও ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হাজরা ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই জাকাউল্লাহ খান পরবর্তীকালে একজন খ্যাতনামা স্থপতির জনক, আর দুই বোন জোহরা সেহগাল ও উজরা বাট ভারতীয় নাটক ও চলচ্চিত্র জগতে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। পরিবারের আরেক বোন আমিনা বেগম করাচিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ পরিবার রোহিলা পাঠান বংশোদ্ভূত, নবাবি পরিবারের সঙ্গেও যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

বন্দি শৈশব, জাগরণের সূচনা
মাত্র দশ বছর বয়সে হাজরাকে পাঠানো হয় লাহোরের কুইন মেরি কলেজে। এটি ছিল অভিজাত মুসলিম মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত আবাসিক স্কুল। সেখানে পড়াশোনার ফাঁকেই হাজরা বুঝতে শুরু করেন নিজের চারপাশের বৈপরীত্য। একদিকে স্কুলের আনুষ্ঠানিকতায় প্রতিনিয়ত ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তি গাওয়া হতো, অন্যদিকে বড় ভাই জাকাউল্লাহ স্কুলের ছুটিতে এসে বলতেন— ‘তুমি কেন উঠে দাঁড়াবে? ব্রিটিশরা আমাদের প্রভু নয়।’ এই দ্বৈত অভিজ্ঞতা কৈশোরেই হাজরার মনে স্বাধীনতার বীজ বুনে দেয়।

কঠোর পর্দার মধ্যে থাকা হাজরার কাছে ভাই ছিলেন আশীর্বাদস্বরূপ, যিনি উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের ধারণা এনে দিয়েছিলেন। বাইরে থেকে আবার ভেসে আসত জাতীয়তাবাদী গান—

‘বলি আম্মা মোহাম্মদ আলী কি, জান বেটা খেলাফতে মেন দে…’

বা

‘চরখা কাতো, চরখা স্বদেশী তরবারি হ্যায়…’

এসব গান তরুণ হাজরাকে অনুপ্রাণিত করত নিজের পথ খুঁজে নিতে।

বিয়ে, অসন্তোষ ও বিচ্ছেদ 
ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করার পরপরই হাজরার বিয়ে হয় চাচাতো ভাই আব্দুল জামিল খানের সঙ্গে, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট। কিন্তু অভিজাত পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে জীবনযাপন তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। মিরাটে বাবার কাছে বেশি সময় কাটাতে শুরু করেন তিনি। এ সময়ই মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছিল, যেখানে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার মামলা করেছিল।

অল্প ক’দিনেই হাজরা উপলব্ধি করেন, এ জীবন তার নয়। তিনি স্বামীকে জানান আলাদা হওয়ার ইচ্ছার কথা। তৎকালীন সমাজে এক নারী এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে কী ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে হয়, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ভাইয়ের পরামর্শে হাজরা বুঝেছিলেন-নিজস্ব পথ বেছে নিতে হলে আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে হবে।

আলীগড় থেকে লন্ডন 
বিচ্ছেদের পর হাজরা বাবার কাছে না থেকে ভাইয়ের সঙ্গে আলীগড়ে চলে আসেন। সেখানে পরিচিত হন তরুণ বামপন্থী চিন্তাবিদ ড. কে এম আশরাফের সঙ্গে। তিনি হাজরাকে পড়তে দেন জর্জ বার্নার্ড শ-এর ইন্টেলিজেন্ট উইমেন্স গাইড টু সোশ্যালিজম অ্যান্ড ক্যাপিটালিজম। বইটি হাজরার জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকতা শিখবেন। নিজের গয়না বিক্রি করে ছেলেকে নিয়ে যান লন্ডনে মন্টেসরি প্রশিক্ষণ নিতে।

লন্ডনে পৌঁছে হাজরা যুক্ত হন সৈয়দ সাজ্জাদ জহির, শওকত ওমর, ড. আশরাফ ও ড. জেড এ আহমেদের মতো প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের দলে। এ ছোট দলে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য। নিয়মিত পাঠচক্র, আলোচনা আর পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তারা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।

লন্ডন থেকে হাজরা অংশ নেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সফরে, ব্রাসেলসে ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলনেও যোগ দেন। এর মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের আসল ভিত্তি তৈরি হয়।

কমিউনিস্ট রাজনীতির কেন্দ্রে হাজরা 
১৯৩৫ সালের পর হাজরা ভারতে ফিরে আসেন এবং যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিআই)। দেশভাগের পর অনেক আত্মীয় পাকিস্তানে গেলেও হাজরা থাকেন ভারতে। এটি ছিল কঠিন সিদ্ধান্ত, কারণ এতে তিনি পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম ভারতেই চালিয়ে যেতে হবে।

ড. জেড এ আহমেদের সঙ্গে দাম্পত্যে যুক্ত হয়ে হাজরা হয়ে ওঠেন এক বিপ্লবী দম্পতির অংশ। একদিকে সংসদে সক্রিয় রাজনীতি, অন্যদিকে শ্রমিক-কৃষক সংগঠিত করা, আবার কারাবরণ-সবকিছুই ছিল তাদের জীবনের অংশ। হাজরা এক পর্যায়ে সিপিআই–এর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সদস্য হন। নারী আন্দোলনের সংগঠন-জাতীয় ভারতীয় নারী ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন ছিলেন তিনি এবং দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভিয়েনার বিশ্ব শান্তি সম্মেলনেও ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও সাহস
১৯৪৯ সালে লখনউতে হাজরা গ্রেপ্তার হন। নেহরু সরকার তখন কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযানে নেমেছিল। হাজরা পাঁচ মাস কারাগারে ছিলেন। সেই সময়ের একটি ঘটনা আজও আলোড়ন জাগায়। গ্রেপ্তারের আগে তিনি মেয়েকে বলেছিলেন— ‘আমি যখন গাড়িতে উঠব, তুমি কেঁদো না। শুধু স্লোগান দিতে থাকো—ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ শিশুটি চোখ ভিজিয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্লোগান দিতে ভোলেনি।

এ দৃশ্য হাজরার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতীক হয়ে আছে-ব্যক্তিগত আরাম ও মাতৃত্বের সুখ ত্যাগ করে তিনি লড়াই করেছিলেন সমতার ভবিষ্যতের জন্য।

দাম্পত্য ও দলীয় দ্বন্দ্ব 
রাজনৈতিক জীবন ব্যক্তিজীবনে আনে তীব্র চাপ। একসময় সিপিআই মহাসচিব বি টি রণদিভ নির্দেশ দিয়েছিলেন, হাজরা যেন স্বামী ড. আহমেদকে তালাক দেন, কারণ তিনি নাকি “সত্যিকারের কমিউনিস্ট” নন। হাজরার উত্তর ছিল স্পষ্ট— ‘আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে বিয়ে করেছি, দল আমাকে তালাক দিতে বাধ্য করতে পারে না।’ এ বক্তব্য প্রমাণ করে হাজরা ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল, স্বাধীনচেতা নারী, যিনি দলীয় শৃঙ্খলার চেয়েও মানবিক সম্পর্ককে মূল্য দিয়েছিলেন।

উত্তরাধিকার ও মৃত্যু 
জীবনের শেষদিকে অসুস্থতায় ভুগলেও হাজরা সক্রিয় ছিলেন রাজনৈতিক মহলে। ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার নাতি আমের রাজা এক কবিতায় লিখেছিলেন—

‘কত নারী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়েছে, নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে? খুব বেশি নয়। আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার নানি ছিলেন হাজরা বেগম।’

কেনো আজ হাজরা বেগম প্রাসঙ্গিক?
আজকের দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে যত আলোচনা হয়, হাজরা বেগমের জীবন সেখানে এক আলোকবর্তিকা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন-নারী শুধু পরিবারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ বদলের সংগ্রামের অগ্রভাগেও দাঁড়াতে পারে। ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা যায়।

তার জীবন আমাদের শেখায়-সাহস, স্থিতিস্থাপকতা আর ত্যাগ শুধু অতীতের গল্প নয়, বর্তমানের প্রয়োজনীয়তাও। হাজরা বেগম ছিলেন এক অনন্য বিপ্লবী নারী, যার জীবনকথা দক্ষিণ এশিয়ার নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অমলিন অধ্যায় হয়ে থাকবে।

লেখক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, অস্টিনে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি হাজরা বেগমের নাতি।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘ডন’-এ ২৪ আগস্ট ২০২৫-এ প্রকাশিত লেখাটি বাংলাদেশের খবরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আরিফুল ইসলাম সাব্বির। 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর