Logo

মতামত

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগের চেষ্টা ব্যর্থ, ‘প্ল্যান বি’তে জাতীয় পার্টি!

Icon

জায়েদ আনসারী

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১:৫৩

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগের চেষ্টা ব্যর্থ, ‘প্ল্যান বি’তে জাতীয় পার্টি!

আমাদের অনেকেরই ইংরেজি বাগধারাটি জানা ‘টিট ফর ট্যাট’ বা যেমন কর্ম তেমন ফল। অনুজদের এ নিয়ে উপদেশও দেই আমরা। তবে নিজেরা মানি কজন! রিপুর তাড়নায় হয়তো বেমালুম তা ভুলে যাই। তবে কর্মফল আমাদের থেকে যায়, যা প্রতিফলিত হয় মানব সমাজে। আদিকাল থেকে এই ধারা অব্যাহত আছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম হিসেবে। এর থেকে পালিয়ে যাওয়ার বা এড়ানোর সুযোগ কারো নেই। আমাদের জীবনাচরণ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে বা প্রভাবিত হয়ে থাকে। উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকে আচরণ পরিবর্তন হয়। তবে বিবেক ও নীতিবোধের উৎসারিত সিদ্ধান্তই কেবল ভুলপথ থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম, যেখানে রিপুর প্রভাব শূন্য থাকে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে রিপুর তাড়না বা লোভ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, মোহ ও নীতিবিবর্জিত কর্মকাণ্ড আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে বিগত কয়েক দশকে। কল্যাণের বাণীর অন্তরালে স্বার্থপরতা, একটি পক্ষকে দমন-পীড়ন করা, সাময়িক লাভের জন্য জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাহ্য করার মতো বহু ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এদেশের মানুষ। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, বাম সংগঠনগুলো কিংবা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি মূলত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। চূড়ান্ত পরিণতি পেতে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক। প্রায় দেড় যুগের একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও সহযোগী শক্তিগুলোকে পরাস্ত করে মানুষের মুক্তির পথটি মসৃণ ছিল না। হাজার হাজার প্রাণ বিসর্জন, আহত, পঙ্গুত্ববরণ ও চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে এসেছে আংশিক মুক্তি। চূড়ান্ত মুক্তি পেতে হলে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে।

চব্বিশের বিপ্লব মূলত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও দোসর জাতীয় পার্টি ও চৌদ্দ দলের বিরুদ্ধে ছিল। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে বিরোধী দলের আসনে থেকে সুবিধা নিয়ে বিরোধী মতাদর্শের নাগরিকদের বিচারিক হত্যাকাণ্ডসহ গুম ও খুন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বৈধতা দিয়েছে।

রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়নে জাতীয় পার্টি এখন আলোচনায়। স্বৈরাচার এরশাদের হাতে গড়া দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতিতে নাটকীয় ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়ে আসছে। তবে এবারের আলোচনা একটু ভিন্ন। দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের। তবে তার বাস্তব প্রমাণও আছে দলটির অতীত কর্মকাণ্ডে। সম্ভবত ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ভারত সফর করেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ভারতের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে সাফ বলে দেন। এসময় বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ রয়েছে বলেও জানান তিনি। এমনকি ভারত অনুমতি দিলে কথা বলবেন এমন বিষয়ও প্রকাশ্যে বলেন তিনি। আর এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে গোলাম মোহাম্মদ কাদের স্পষ্ট বলেছেন, আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দলটির বিচার পরিচালনারও সমালোচনা করেন তিনি। এসব কারণে অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক শক্তি ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা জাপার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন বা ফেরানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনছেন।

তবে কিভাবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে দলটি কাজ করছে তারও প্রমাণ স্পষ্ট। গত ২৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীদের সেনাবাহিনী ও পুলিশের বর্বর লাঠিপেটা তারই ইঙ্গিত দেয়। দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, দলটির সভাপতি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় হামলা চালানো হয়েছে। তবে তার আগে নুর ও দলের সেক্রেটারিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ফোন করে জাতীয় পার্টির বিষয়ে কথা না বলতে বলা হয় বলে দাবি করা হয়েছে। ওইদিন সন্ধ্যায় গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা মশাল মিছিল করার সময় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।

জাতীয় পার্টির বিগত সময় বিশেষ করে দেড় দশকের ভূমিকার কারণে গণঅভ্যুত্থানের স্টেকরা আওয়ামী লীগের দোসর বলে মনে করে। ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে অনেকে। স্টেকহোল্ডাররা এমন আশঙ্কাও করছেন যে, জাতীয় পার্টির মোড়কে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসার চেষ্টা করবে। এর যথেষ্ট কারণও ইতোমধ্যে প্রতীয়মান তাদের দৃষ্টিতে। জিএম কাদের যেহেতু ভারতের প্রেসক্রিপশনে রাজনীতি করেন, সেহেতু ভারতের আজ্ঞাবহ দলীয় প্রধান হিসেবে দলের মধ্যে ভারতীয় আওয়ামী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অতীতে দেখা গেছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব কে দেবেন রওশন এরশাদ না জিএম কাদের— তাও আওয়ামী লীগ তথা ভারত ঠিক করে দিয়েছিল। ভারত–জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের যৌথ মিশনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ফেরানো কিংবা অবস্থান করে নেওয়ার চেষ্টার বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের নলেজে রয়েছে, যা একজন উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরুল হক নুরকে দেখতে গিয়ে এমনি একটি মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। যেহেতু ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তাই জাতীয় পার্টির ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। জাতীয় পার্টি হচ্ছে চিহ্নিত ফ্যাসিবাদী দল।

রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর জাতীয় পার্টিতে ভর করে ফেরার কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত: আওয়ামী লীগ যেভাবে রয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি করার সুযোগ হবে না। আর বিচারিক প্রক্রিয়া কতদিন চলবে তাও তো বলা যাচ্ছে না। সংঘটিত অপরাধের দায় এড়ানোর সুযোগও থাকবে না দলটির। আল্টিমেটলি দল অভিযুক্ত ও নেতারা দণ্ডিত হওয়ার চান্স থাকতে পারে। জেন জি জেনারেশনকে মিস করবে আওয়ামী লীগ। নতুন ইতিহাসে দেশের মানুষকে হত্যাকারীর দল হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে দলটির— যা আদালতের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। দ্বিতীয়ত: নির্বাচনে পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতধারায় স্বাভাবিক হওয়ার তৎপরতা চালাবে দলটি, যার মাধ্যমে অতীতকে ভোলানোর চেষ্টা বা চাপা দেওয়ার পদক্ষেপ থাকবে দলটির। তৃতীয়ত: জাপাও চাইবে দোসর ট্যাগ থেকে বের হয়ে আসতে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে মূল ধারার রাজনীতিতে টিকে থাকতে। এজন্য ‘প্ল্যান এ’ ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ‘প্ল্যান বি’ প্রয়োগের চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। প্ল্যান বি বাস্তবায়ন করতে পারলে গণঅভ্যুত্থানের স্টেকদের জন্য এক প্রকার থ্রেট তৈরি হবে। অর্থাৎ নিজেদের বৈধ দাবি করে তারা আবারও সংগঠিত হয়ে রাজনীতির মোড় ঘুরানোর চেষ্টা করবে। এজন্য অভ্যুত্থানের স্টেকরা চাইছে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিরও কার্যক্রম নিষিদ্ধ। যা এমন ঝুঁকি থেকে জুলাই অভ্যুত্থান ও দেশকে রক্ষা করবে।

অভ্যুত্থানের পর আসলে পরাজিত ফ্যাসিবাদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। হ্যাঁ, তাদের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে মানবাধিকার সুরক্ষিত করতে হবে। দায়মুক্তির সুযোগ নেই। আর ক্ষুদ্র স্বার্থে তা হলে অভ্যুত্থানের চেতনা ভুলুণ্ঠিত হবে। দেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে। এজন্য জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে বলে আপাতত প্রতীয়মান হচ্ছে। ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকেও জামায়াত ও এনসিপি ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। তবে বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনায় এটি থাকেনি। দলগুলোর এমন অবস্থান ভোটের রাজনীতি না জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্যের উপর— তা স্পষ্ট হতে আরও সময় ব্যয় করতে হবে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা নিয়ে জুলাই স্টেকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সবার আকাঙ্ক্ষা অভিন্ন— গণতান্ত্রিক সরকারের উত্তরণ। ফ্যাসিবাদের দোসর কিংবা আওয়ামী লেসপেন্সার হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হলে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে কিনা— এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে। তবে এখানে স্পষ্ট অবস্থান থাকা দরকার যে, অভ্যুত্থানের বিপক্ষের শক্তির অংশগ্রহণ নির্বাচনে মুখ্য নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ যেমন অভিযুক্ত দল, তেমনি জাতীয় পার্টিও অভিযুক্ত। তবে আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর প্রভাবও বিবেচনায় রেখে কূটনৈতিক সক্ষমতায় তা মোকাবিলা করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বয়ানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ মূখ্য হয়ে উঠার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অভ্যুত্থানের স্টেকদেরই নির্ধারণ করতে হবে। ডিপোজড পাওয়ার বা প্রতিবেশী দেশের বয়ানের উপর ভিত্তি করে নয়। রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দাদাগিরির সুযোগ নেই। এজন্য এ বি সি ডি প্ল্যান নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর