ডাকসু নির্বাচন : জাতীয় সংকট উত্তরণের পথরেখা নির্মাণ করবে কী?

জায়েদ আনসারী
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০:০২

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। আর মাত্র দুদিন বাকি। আজই শেষ হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা। ডাকসু নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যেই নিয়েছে নানা প্রস্তুতি। এবারের বৈচিত্র্যপূর্ণ নির্বাচনে সব মত ও পথের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। বিশেষ করে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক উদার চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পর নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে। তবে চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র স্বৈরাচারের চিহ্নিত দোসররা এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাচ্ছেন না।
এবারের ডাকসু নির্বাচনটি স্বভাবতই এক্সক্লুসিভও ও ইনক্লুসিভ। কারণ শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদে লড়ছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাগছাস, বামসংগঠন, অন্যান্য ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্যানেল লড়ছেন নির্বাচনে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে আলোচনায় রয়েছে দুটি প্যানেল। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি ছাত্র ও ছাত্রীদের ২০টি হলের হল সংসদ নির্বাচনও এদিন হবে। এসব নির্বাচনেও ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনে ৮টি ভোট কেন্দ্র ও ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে। একজন ভোটার গড়ে ১০ মিনিট সময় নিলেও কোনোরকম বিঘ্ন ছাড়াই সকল কেন্দ্রে নির্ধারিত সময় বিকাল ৪টার মধ্যে ভোটদান সম্পন্ন হওয়া সম্ভব হবে কর্তৃপক্ষ আশা প্রকাশ করেছেন। বিকাল ৪টার মধ্যে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে ভোটার লাইনে দাঁড়ানো সকল ভোটার ভোট দিতে সক্ষম হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন নির্বাচন পরিচালনায় সংশ্লিষ্টরা।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানিয়েছে চিফ রিটার্নিং অফিসার। গতকাল শনিবার এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ডাকসু নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বশেষ বাসের সময়সূচি দেখে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আজ দুপুর ১২টায় বিজ্ঞান অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভোটার সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠিত হবে। ডাকসু ও হল সংসদের সকল ভোটারদের ভোট প্রদানের পূর্ব প্রস্ততিমূলক সভায় যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনের আগের দিন অর্থাৎ গতকাল শনিবার এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, প্রার্থী বাছাই, ভোটদানে ইচ্ছুক ও অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মতামত ও পছন্দের প্রার্থীদের ভোটদানের বিষয়ে মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছে কয়েকটি জরিপকারী সংগঠন।
পৃথক দুটি সংগঠনের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ছাত্রশিবির এগিয়ে রয়েছে বলে উঠে এসেছে। তবে অন্য প্যানেলগুলো জরিপের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে প্রচারণা ও শিক্ষার্থীদের মনোভাব জরিপের ফলাফলকে সমর্থন করে অনেকাংশেই। ইতোমধ্যে এমন বিষয়ও চাউর হয়েছে যে নারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থী আবু সাদিক কায়েমকে ভোট দেবেন বলে ছুটিতে বাড়ি যাননি।
ন্যারেটিভ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম পরিচালিত জরিপের প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ভিপি পদে প্রায় ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী শিবির সমর্থিত প্যানেলের সাদিক কায়েমকে ভোট দেবেন বলে মতামত দিয়েছেন। আর ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম আবিদকে ১৪ শতাংশ ভোট দেবেন। স্বতন্ত্র জোটের উমামা ফাতেমাকে ৯ শতাংশ ভোট দেবেন। আর ৮ শতাংশ ভোট দেবেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী আবদুল কাদেরকে। এভাবে অন্যান্য পদেও শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন। এর অর্থ হলো এবার নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল।
ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও যে ঘটে তা নয়। নারীদের হেনস্তা, সাইবার বুলিং, প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট, গণধর্ষণের হুমকি ও অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল প্রচারণায় বহিরাগতদের ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। সামাবিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকটি ভিডিওতেও এমন বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ছাত্রদল পরিচয় দেওয়া এক শিক্ষার্থী প্রশ্নের মুখে তো বলেই ফেলেছেন তিনি ‘রোকেয়া হলে’ থাকেন— যা হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। রোকেয়া হল মূলত নারী শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল। কয়েকজন ছাত্রদল পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি পড়ালেখা করেন না বলেও গণমাধ্যমের সামনে শিকার করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে— ছাত্র না হয়েও তারা ছাত্রদল করেন কীভাবে? তাদের ক্যাম্পাসে আনলোই বা কারা? তবে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হলো এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেনি— এমন অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সবচেয়ে চরম ব্যর্থতা হলো ছাত্রশিবিরের প্রচারণার ফেস্টুনে নারী শিক্ষার্থীর ছবি বিকৃতকারীকে বিচারের আওতায় আনতে না পারা।
অন্যদিকে ছাত্রদলের পক্ষে বহিরাগতদের আরও বেশকিছু প্রচারণা ও ভোট চাওয়ার বিষয়ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা যায়, বিএনপির ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতারা তাদের এলাকার ঢাবি শিক্ষার্থীদের ফোন করে ভোট চাচ্ছেন। কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী রীতিমতো ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। এমনকি ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের সঙ্গে তারা ভোটারদের যোগাযোগ করতে বলেছেন। এমনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ পদক্ষেপ নিয়েছে। অভিযুক্তকে বহিষ্কারও করেছে। তবে এক-দু’টো ঘটনায় মিডিয়ায় এসেছে। যেসব আসেনি সেগুলোর কী হবে?
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সারাদেশের মানুষের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে। সবার দৃষ্টি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কারণ চব্বিশের অভ্যুত্থান আন্দোলনের সূতিকাগার এই ক্যাম্পাসে মুক্ত পরিবেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একই স্পিরিট ধারণ করেন। তারা কতটুকু সহনশীলতার পরিচয় দেবেন নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন উত্তর। তবে ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেছেন তারা হারলেও জিতে যাবেন। কারণ প্রার্থীরা সবাই জুলাই যোদ্ধা। সম্প্রতি তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আরেক ভিপি প্রার্থী আবিদও।
ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সংগঠনটিকে দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য সকল সংগঠন কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধা দিয়ে আসছিল। কিন্তু এবার তারা বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে নানা জরিপ ও শিক্ষার্থীদের অভিমত সেটি তুলে এসেছে। একইভাবে দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্রশিবির কার্যক্রম স্বাভাবিক করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সংগঠনটির রাজনৈতিক পথচলায় দলীয় কয়েকশত নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তাদের প্রকাশিত ডায়েরির তথ্যানুযায়ী সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ ও অন্যান্য বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর হামলায়। বর্তমান সময়ে দেশের বৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে ক্রিয়াশীল ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাগছাস। নির্বাচনের পর বা আগামী দিনগুলোতে এই ছাত্রসংগঠনগুলো পুরোনো ধাঁচে ফিরবে না, সহনশীলতার রাজনীতি করবে তা এখন দেখার বিষয়।
ডাকসু নির্বাচনকে অনেকেই জাতির আগামী দিনের সংকট উত্তরণের পথরেখা হিসেবে বিবেচনা করছেন। কারণ মুক্ত, স্বাধীন, সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার মোক্ষম সন্ধিক্ষণ হলো ডাকসু নির্বাচন। এটি যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, সহাবস্থান নিশ্চিত হয়, শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস বিনির্মাণে সহায়ক হয়— তবেই তা জাতিকে পথরেখা দেখাবে। সংকট সমাধানে জাতীয় রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা নতুন প্রেরণা পেতে পারেন। নতুন ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে সচেতন জনগণের। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিছিল থেকে ‘ধর ধর শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ এমন স্লোগান দিতে শোনা গেছে। যা একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেছেন জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদ। সবার প্রত্যাশা এমন অশালীন ও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিমুক্ত হোক ক্যাম্পাস। তবেই কেবল তা জাতিকে স্বপ্ন ছোঁয়ার পথরেখা দিতে পারবে।
জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব ফেলবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, ডাকসু নির্বাচনের পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও নির্বাচন হবে। সেগুলোতেও ছাত্রশিবির ভালো করবে বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা যাচ্ছে। কারণ চব্বিশ পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে সংগঠনটির কার্যক্রম শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে উঠে এসেছে। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ লেজুরবৃত্তির রাজনীতির অবসান চাইছেন। তার প্রতিফলন হয়তো ভোটে পড়বে। এর প্রভাব যে জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুস্থধারার রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে না আসলে জাতীয় সংকট গভীর হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com