
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
শুধু সিস্টেম পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন মানুষের ভেতরের পরিবর্তন। কৌতুক দিয়ে শুরু করি-
— মা, একটা সাবান দাও।
— এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা সাবান নিলে, আবার সাবান?
— ওই সাবানটা তো ময়লা হয়ে গেছে, তাই সাবানটাকেই পরিষ্কার করতে হবে।
সরল এক কথোপকথন, সামান্য হাস্যরসের কৌতুক। কিন্তু এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের নির্মম বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা, যা প্রায় প্রতিদিনই আমরা প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু অনেক সময় উপলব্ধি করি না।
আমাদের সিস্টেম, সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্রযন্ত্র, সবই যেন সেই সাবানের মতো। যার কাজ মানুষের কল্যাণ সাধন করা, অপরাধ ও অন্যায়কে মুছে দেওয়া, দুর্নীতির দাগ ঘুচিয়ে সমাজকে পরিষ্কার রাখা। অথচ সময়ের পরিক্রমায় সিস্টেমটিই হয়ে ওঠে দূষিত, কলুষিত। সাবানের মতোই, যা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার কথা, কিছুদিনের মধ্যে সেটিই নিজেই হয়ে ওঠে ময়লার আধার।
নতুন কাঠামোর স্বপ্ন, পুরনো রোগের পুনরাবৃত্তি
আমরা বারবার পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি। নতুন সরকার, নতুন দল, নতুন আন্দোলন কিংবা নতুন আইন, এসব নিয়ে ভরসা খুঁজি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কাঠামো পাল্টালেও সব সময় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না। এক নতুন সিস্টেমও অল্পদিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়ে একই সমস্যায়-লোভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অব্যবস্থাপনায়।
এ যেন এক অনন্ত চক্র— আমরা সাবান পাল্টাই, কিন্তু হাতের ময়লা পাল্টাই না। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই নতুন সাবানও হয়ে ওঠে মলিন, হারায় তার শুদ্ধতা।
মানুষ, নাকি সিস্টেম, পরিবর্তন কোথায়?
প্রধান প্রশ্ন এখানেই। সমস্যাটা কি সিস্টেমে, নাকি সিস্টেম পরিচালনাকারী মানুষের ভেতরে?
অসৎ মানুষের হাতে কোনো সৎ প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। আবার শুদ্ধ মানুষের হাতে দুর্বল কাঠামোও টিকে যায় ন্যায়ের শক্তিতে।
সুতরাং রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে নির্মল করতে হলে বদলাতে হবে মানুষকে। বাহ্যিক পরিবর্তনের আগে চাই ভেতরের পরিবর্তন। আইন, আন্দোলন, সংবিধান, এসব কেবল বাহ্যিক কাঠামো। এগুলো চলবে তখনই, যখন এর চালকরা সৎ, সচেতন ও দায়িত্ববান হবেন।
স্বচ্ছ সমাজ গড়ার উপায়
একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুন্দর রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে চাই—
- ন্যায় ও সত্যের প্রতি অবিচল অবস্থান : অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধ ছাড়া সমাজ কখনো শুদ্ধ হয় না।
- মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ : একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা দুর্নীতির অনেক পথ বন্ধ করে দেয়।
- সৎ নেতৃত্ব ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান : নেতৃত্বে যদি সততা না থাকে, তবে গোটা সমাজ অচিরেই দূষিত হয়ে পড়ে।
- নৈতিক শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধি : পৃথিবীর বহু দেশ আজ ‘Ethics Education’-এর উপর জোর দিচ্ছে। কোথাও ধর্মীয় অনুশাসন, কোথাও মানবিক মূল্যবোধ শেখানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষকে ভেতর থেকে শুদ্ধ করা। এদেশে কিছু বিদেশী সংস্থা Ethics Education উপর এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
শুধু সিস্টেম নয়, মানুষকেই বদলাতে হবে
রাষ্ট্রের সৌন্দর্য কোনো নতুন সংবিধান বা নতুন দলের মাধ্যমে কেবল গড়ে ওঠে না; এর ভিত্তি স্থাপিত হয় মানুষের চিন্তা, মনন ও নৈতিকতায়। প্রতিটি নাগরিক যখন নিজের ভেতরের ময়লা ধুয়ে ফেলতে সক্ষম হবে, তখনই সম্ভব হবে সত্যিকার অর্থে নির্মল রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
একজন মানুষ যখন সত্যের পথে হাঁটে, তখন তার চারপাশে আরেকজন প্রভাবিত হয়। ধীরে ধীরে সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। পরিবর্তন শুরু হয় ক্ষুদ্র থেকে, ভেতর থেকে— বাহিরের সব পরিবর্তন তার পরিণাম মাত্র।
পরিশেষে বলতে পারি, পরিবর্তনের শুরু তাই বাইরে নয়, ভেতরে। আমরা যদি নিজেদের ভেতরের ময়লা ধুয়ে ফেলতে পারি, তবে নতুন সিস্টেম বারবার পাল্টাতে হবে না। শুদ্ধ মানুষই শুদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। তাহলেই একদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব, আমাদের সমাজ, এমনকি আমাদের রাষ্ট্র আর ময়লা সাবানের মতো নয়, বরং নির্মল জলের মতো স্বচ্ছ।
লেখক : সহব্যবস্থাপক (এইচআর, অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স), বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com