Logo

মতামত

বদরুদ্দীন উমর : চিন্তার সাহসী ভাস্কর

Icon

সাজ্জাদ শরিফ

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৬

বদরুদ্দীন উমর : চিন্তার সাহসী ভাস্কর

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের এক অনন্য বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল সমাজ-তাত্ত্বিক ও সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। তাই বদরুদ্দীন উমর এদেশের চিন্তাজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি শুধু একজন লেখক বা রাজনৈতিক কর্মী নন, বরং একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ, মার্কসবাদী চিন্তক এবং প্রবন্ধকার। সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণকারী এক সাহসী কণ্ঠস্বর। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রতিটি অধ্যায় প্রমাণ করে, তিনি প্রচলিত ধ্যানধারণা ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত না করে কলম চালিয়েছেন। তবে তাঁর রচনা ও কর্মকাণ্ড আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে আলোচনার, সমালোচনার ও মতানৈক্যের জন্ম দিয়েছে।

১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া বদরুদ্দীন উমর উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন দেশবিদেশে। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন করলেও তাঁর চিন্তার বিস্তার কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতি— সব ক্ষেত্রেই তিনি গভীরভাবে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পূর্ব-পরবর্তী সময়ে তিনি সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রশ্নে যেসব বই লিখেছেন, সেগুলো এখনো পাঠকের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক।

উমরের অন্যতম বড় পরিচয় হলো তাঁর বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মার্কসবাদকে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে নয়, বরং ইতিহাস ও সমাজ বিশ্লেষণের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিশ্লেষণের এই পদ্ধতিই তাকে কমিউনিস্ট মতবাদে আগ্রহী করে তোলে। কারণ, সমাজ, দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তার মননশীল চেতনা ও আগ্রহ তৈরি হয় পারিবারিক সূত্রেই। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তার জীবনের শুরুর দিকে চিন্তাভাবনায় ইসলামি প্রভাব থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সেই সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা এবং জানাশোনা বাড়তে থাকে। তবে অক্সফোর্ডে যাওয়ার পর তার মার্ক্সপন্থী ভাবনা পূর্ণতা পায়। একথাগুলো তিনি নিজেই একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছেন। পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম— এসব ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা ও বিশ্লেষণ বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর কাজগুলো গবেষক মহলে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তবে উমরের চিন্তা ও অবস্থান কখনোই বিতর্কমুক্ত ছিল না। বামপন্থী রাজনীতি ও মতাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তিনি ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী উভয় গোষ্ঠীর কাছেই সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর লেখায় ইসলামি ধারার মূল্যায়নকে অনেকেই একপাক্ষিক বলে মনে করেন। আশ্চর্যজনকভাবে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে তিনি ছিলেন একেবারেই নীরব। তিনি স্বাধীনতার পর অনেক প্রগতিশীল চিন্তাবিদ যখন আপসের পথে হাঁটলেন, বদরুদ্দীন উমর তখনও আপসহীনভাবে রাষ্ট্রের ভুলনীতি, শোষণ ও বৈষম্যের সমালোচনা করে গেছেন। ফলে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন, সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন, এমনকি নিপীড়িতও হয়েছেন। তবু তাঁর অবস্থান নড়ে যায়নি। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রায়শই কঠোর হয়ে ওঠা তাঁর সমালোচনা সচেতন পাঠকের কাছে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়েছে। তবে এসব সমালোচনার মাঝেও তিনি নির্দ্বিধায় নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন— যা তাঁকে ‘বিতর্কিত হলেও প্রাসঙ্গিক’ করে রেখেছে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে বদরুদ্দীন উমরের অন্যতম বড় অবদান হলো সংস্কৃতি ও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের তত্ত্ব স্পষ্টভাবে সামনে আনা। তিনি দেখিয়েছেন, সংস্কৃতি কখনোই নিরপেক্ষ নয়; বরং এটি সমাজের শ্রেণি-স্বার্থ ও অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে প্রগতিশীল ও বামপন্থী চিন্তার জগতে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাজনীতি শিক্ষা সংস্কৃতি’ বইটি এখনো বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য এক মাইলফলক।

লেখক হিসেবে বদরুদ্দীন উমর অত্যন্ত প্রাঞ্জল, বিশ্লেষণধর্মী ও যুক্তিনিষ্ঠ। তাঁর লেখায় তথ্যের ব্যবহার ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দুটোই সমানভাবে উপস্থিত থাকে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কঠিন বিষয়গুলো অতি সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন, যদিও মাঝে মাঝে তাঁর ভাষা জটিল ও ভারী মনে হতে পারে। তিনি ব্যক্তিগত আবেগ বা রাজনৈতিক সুবিধার খাতিরে ইতিহাসকে বিকৃত করেননি। বরং দলিল-তথ্য, যুক্তির নিরিখে সমাজ ও রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর রচনা পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি কেবল একজন তাত্ত্বিক নন, বরং বাস্তবতাকে পরিবর্তন করতে উদগ্রীব এক সংগ্রামী। নিরপেক্ষভাবে বললে, বদরুদ্দীন উমরের অবদান হলো বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজচর্চায় এক বিকল্প দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা। তাঁর চিন্তা সবাই গ্রহণ করবে এমন নয়, কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তিনি এমন একজন সমালোচক ও নির্মাতা—যিনি প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন আলোচনার ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে বদরুদ্দীন উমরের ভূমিকা দ্ব্যর্থহীনভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরোধিতা করে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্যভূমিকা পালন করেছিলেন। এটি তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যেমন দৃঢ় করেছে, তেমনি তাঁকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূত্রে গড়ে ওঠা সংগঠন ও উদ্যোগগুলো তরুণ প্রজন্মকে সাহস জুগিয়েছে বার বার।

বদরুদ্দীন উমর আর নেই। কিন্তু আজকের দিনেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বদরুদ্দীন উমরকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, তিনি নিছক একজন বামপন্থী চিন্তাবিদ নন; তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এক দৃঢ়চেতা বুদ্ধিজীবী। একদিকে চিন্তার ভাণ্ডার, অন্যদিকে কর্মপ্রেরণার উৎস। তাঁর কাজের মধ্যে পক্ষপাত থাকতে পারে, কিন্তু গবেষণা ও লেখার জগতে তাঁর নিষ্ঠা ও সংগ্রাম তাঁকে অস্বীকার করার সুযোগ দেয় না। তাঁর লেখনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের গভীরে প্রোথিত শোষণ ও বৈষম্যকে ভাঙতে হলে কেবল স্লোগান নয়, প্রয়োজন তাত্ত্বিক ভিত্তি ও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।

সর্বোপরি বলা যায়, বদরুদ্দীন উমর হচ্ছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর চিন্তা, গবেষণা ও  লেখালেখি আমাদের ইতিহাসে নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেছে প্রতিনিয়ত। ভাবতে শিখিয়েছে নতুন করে। সময় যতই এগিয়ে যাক, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা থাকবেই। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন— সাহসী চিন্তা ছাড়া কোনো জাতি এগোতে পারে না। সুতরাং সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আপসহীন মনোভাব অপরিহার্য।

সাজ্জাদ শরিফ : লেখক ও সাংবাদিক; প্রধান সম্পাদক, কাতেবিন 

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর