Logo

মতামত

অতি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিরক্ত তরুণরা

নিয়ন মতিয়ুল

নিয়ন মতিয়ুল

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৩৭

অতি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিরক্ত তরুণরা

মানুষের সামনে যখন কোনো তথ্য বারবার আসে, মস্তিষ্ক সেটিকে সহজ ও পরিচিত মনে করতে থাকে। এক পর্যায়ে সেই তথ্যকে সত্য বলে ধরে নিতে শুরু করে। তথ্য প্রক্রিয়া করার এই প্রবণতা মনোবিজ্ঞানে ‘ইলিউসরি ট্রুথ এফেক্ট’ অথবা ‘সত্যের বিভ্রম’ হিসেবে আলোচিত। মানবমস্তিষ্কের এই দুর্বলতার সুযোগেই নাৎসী জার্মানির তথ্যমন্ত্রী পল জোসেফ গোয়েবলস (১৮৯৭–১৯৪৫) সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে লোকজন এক সময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’

মস্তিষ্কের এমন প্রবণতা যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা বা কৌশল নির্ধারণে শাসক বা রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করে আসছে। আবার দেখা গেছে, বারবার শুনে কোনো কিছু পরিচিত মনে হলে, তা সহজবোধ্য হয়। ‘কগনেটিভ এজ’ বা জ্ঞানীয় প্রশান্তি সৃষ্টি করে। যে কারণে মানুষ সহজে কোনো তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং মেনে নেয়। জটিল কোনো ঘটনার সহজ ব্যাখ্যাতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মনোজাগতিক এই বৈশিষ্ট্য ‘কগনেটিভ বায়াস থিওরি’ নামে পরিচিত। যে কারণে কোনো ঘটনাকে কল্পনার রংতুলি দিয়ে রহস্যময় করে তুললেও মানুষ তা মানতে চায়। আর এখান থেকেই তৈরি হয়েছে ‘কন্সপিরেসি থিওরি’ বা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ. বুশের সময়কালে রাজনীতিতে ‘পোস্ট-ট্রুথ পলিটিক্স’ নামে আরেকটি তত্ত্ব হাজির হয়। যেখানে তথ্য-প্রমাণের চেয়ে আবেগ ও বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে দারুণভাবে কার্যকর হয় ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। প্রেসিডেন্ট বুশ সেই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ও আল-কায়েদার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের কথিত যোগসূত্রের গল্প ফেঁদেছিলেন। মার্কিন জনগণও সেই ফাঁদে আটকা পড়েছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ডের সম্মিলিত বাহিনী ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে আক্রমণ করে বসে। যা চলতে থাকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। তবে ইরাক তছনছ করার পরও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

শুধু জর্জ বুশই নন, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কের এরদোয়ান, ব্রাজিলের বলসোনারো ও ফিলিপাইনের রোদ্রিগো দুতের্তেসসহ বিশ্বের বহু পপুলিস্ট নেতা বিরোধীদের দুর্বল দেখাতে এভাবেই ভয়ঙ্করভাবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যবহার করেছেন, করে যাচ্ছেনও। তারা ‘গভীর রাষ্ট্র’ বা ‘ডিপ স্টেট’, ‘মিডিয়া কারসাজি’, ‘বিদেশি শত্রু’— এগুলো ব্যবহার করছেন জনগণের ইচ্ছাকে দমন করার অস্ত্র হিসেবে। বর্তমান ইন্টারনেট দুনিয়ায় এসব অদৃশ্য ‘মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র’ ছড়ানোর সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে অ্যালগরিদমভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া।

তত্ত্বটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে কল্পনার রংতুলি দিয়ে রহস্যময় করে তোলার প্রবণতা।’ যেখানে রাজনীতিকরা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে ঠাণ্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে, খেয়াল খুশিমতো রহস্যময় দুর্বোধ্য কল্পকাহিনি সাজিয়ে প্রচার করেন। সরকার ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের নীতি ব্যর্থতা বা জনঅসন্তোষকে অস্বীকার করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ, নীতির ব্যর্থতাকে তত্ত্বের ঘাড়ে চাপাতে পারলে দায়িত্বশীলতা কমে যায়। ফলে বিরোধীদের দমন ও দায়মুক্তির কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হয় তত্ত্বটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনের মতো রঙ লাগিয়ে তৈরি এসব কল্পিত কাহিনি এখন শুধু ‘অজ্ঞ জনগণের ভুল বিশ্বাসেই’ আটকে নেই, বরং রাষ্ট্র, দল ও নেতাদের ঠাণ্ডা মাথার রাজনৈতিক কৌশল হয়ে গেছে।

বাংলাদেশেও বহুদিন ধরে বিরোধী মত দমনে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কার্যকরভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। যেখানে পরিভাষা হিসেবে ‘বিদেশি শক্তির এজেন্ডা’, ‘গোপন ষড়যন্ত্র’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত’ শব্দগুলো বারবার উচ্চারণ হচ্ছে। যাতে বিরোধী পক্ষের বৈধ রাজনৈতিক দাবি দুর্বল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে ‘ন্যায্যতা’ পায়। যে কোনো আন্দোলনের মধ্যেই ‘ভারত, আমেরিকা বা পাকিস্তানের মদদ’ অথবা ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করা সহজ হয়।

মূলত, ভূরাজনীতির কারণেই বাংলাদেশ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের এক উর্বর ভূমি। ভারত, চীন, মায়ানমার, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত অবস্থান সব সময়ই এখানে আঞ্চলিক রাজনীতির চাপ বাড়ায়। ফলে প্রতিপক্ষকে ‘বিদেশি শক্তির হাতিয়ার’ হিসেবে অভিযুক্ত করার দারুণ সুযোগ তৈরি হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের মাপকাঠিতে কে স্বাধীনতাযুদ্ধবিরোধী, কে দেশবিরোধী, আর কে নয়— এমন বাইনারি রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট আকার নেয়। যা তত্ত্বটিকে ব্যবহারের বৈধতা দেয়। দেশের অন্যতম প্রধান দুই রাজনৈতিক দল— আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক ক্ষেত্রে মতাদর্শিক অবস্থা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক প্রতিশোধের পর্যায়ে চলে যায়। ‘বিদেশি এজেন্ট’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ বা ‘গোপন চক্রান্ত’ ইত্যাদি শব্দের মোড়কে পরস্পরে ঘায়েল করা হয়।

তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি ও শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি হওয়ায় রাজনীতির কল্পিত এসব গল্প দেশের আনাচে-কানাচে দ্রুত ছড়ানো সহজ হয়েছে। প্রমাণ করার সুযোগ না থাকায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই তা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচন কিংবা জাতীয় কোনো সংকট দেখা দিলে মুখরোচক গল্পগুলো সাধারণ মানুষ লুফে নেয়, উত্তেজনার বশে বিশ্বাসও করে। ফলে দায়মুক্তির কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যর্থ নীতি, দুর্নীতি বা সংকট তত্ত্বের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে থাকে। বিশেষ করে ‘দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে বিদেশি চক্রান্ত’ অথবা ‘আন্দোলন উসকে দিতে বিদেশি গোয়েন্দা’ হাজির করেন।

তরুণরা বিরক্ত
দশকের পর দশক ধরে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ রাজনীতির মাঠ পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, জনপরিসরেও ঢুকে পড়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, নিরীহ সব আন্দোলন দমাতে কিংবা ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে তত্ত্বের সফল ব্যবহার নেতা বা দলগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করিয়েছে, তবে বর্তমান তরুণরা সেসব কল্পিত তত্ত্বে আর বিশ্বাসী নয়। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, অনলাইন পোর্টাল ইত্যাদির মাধ্যমে জাতীয় ও বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে বহুমুখী সত্য তথ্য পাচ্ছে। যে কারণে নেতা বা দলের ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য বা একতরফা বয়ান সহজে গ্রহণ করছে না। বলা যায়, দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ ও বিশ্বাস অনেকটা শূন্যের কোটায় নেমেছে।

বিশেষ করে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাস্তবমুখী রাজনীতি নিয়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে নেতাদের রহস্যজনক, দুর্বোধ্য, একঘেঁয়ে বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করছে। গতানুগতিক অতীতমুখী রাজনীতির বদলে তরুণরা কর্মসংস্থান, দক্ষতা, জীবনমান, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক যোগাযোগ সংক্রান্ত বাস্তব ইস্যুগুলো নিয়েই বেশি মনোযোগী। ইতিহাসনির্ভর আদর্শ কিংবা ষড়যন্ত্রকেন্দ্রিক বিতর্কের বদলে ‘তাদের ভবিষ্যৎ কোথায়’— এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশি উদগ্রীব। কারণ, ইন্টারনেট আর বিদেশে পড়ালেখার সুযোগে তরুণরা এখন বিশ্বমুখী। নিজেদের বিশ্বনাগরিকও মনে করছে। তারা বুঝতে পারে, সমস্যার সমাধান ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ধোঁয়াশায় নয়, বাস্তবমুখী রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠান গঠনের মধ্য দিয়েই সম্ভব।

তাছাড়া দীর্ঘদিনের দলীয় বিরোধ, একে অপরকে অযৌক্তিকভাবে দোষারোপ, অসংসদীয় ভাষায় আক্রমণ— সবকিছুর মধ্যেই ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করার রাজনীতি তাদের কাছে এখন চরম বিরক্তিকর। ফলে এসব নেতা বা দলকে এড়িয়ে তারা বাস্তব, যৌক্তিক ও প্রমাণনির্ভর আলোচনা পছন্দ করছে, তেমনি নতুন ধরনের রাজনৈতিক ভাষা ও নেতৃত্বও খুঁজছে। যেখানে রূপকথাভিত্তিক গল্পের বাড়াবাড়ি নয়, বরং প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও টেকসই উন্নয়ন গুরুত্ব পাবে।

বিখ্যাত মার্কিন লেখক, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট ও দার্শনিক নোম চমস্কি বলেছিলেন, ‘জনগণ হচ্ছে বিভ্রান্ত পশুর পালের মতো। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ না থাকলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ‘ক্যালকুলেটেড ম্যানুফ্যাকচার অফ কনসেন্টের’ মাধ্যমে।’ একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে এসে নতুন প্রজন্ম তথা জেন-জিরা আর বিভ্রান্ত পশুর পাল হয়ে থাকতে চায় না। তারা দারুণ কৌতূহলী, বাস্তবমুখী, বক্তব্যে সোজাসাফটা। তারা রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের মতো সনাতনী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চায়। 

বলা বাহুল্য, দেশীয় রাজনীতিতে বর্তমানে বেশি আলোচনায় এসেছে পশ্চিমা ধারার ‘ডিপ স্টেট’ ধারণা। রাজনৈতিক দল বা নেতারা এখন নিজেদের পরাজয় কিংবা ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করতে এটি ব্যবহার করছেন। তবে বিরোধীরা এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করছে গোপন কোনো শক্তি হিসেবে, যার মধ্যে সামরিক, ব্যুরোক্রেসি, গোয়েন্দা সংস্থা বা বিদেশি স্বার্থগোষ্ঠী রয়েছে, যারা পর্দার আড়াল থেকে সরকারকে টিকিয়ে রাখে বা বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করে। 

একাডেমিশিয়ানরাও মনে করছেন, দেশে কিছু স্থায়ী ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে, সরকার পাল্টালেও যেগুলো প্রভাবশালী থেকে যায়। তবে পশ্চিমা গবেষকরা ‘ডিপ স্টেট’ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, সহজেই এটা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থায়ী ক্ষমতাকাঠামো অস্বীকার করা না গেলেও ‘ডিপ স্টেট’ ধারণা যে রাজনৈতিক দলগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্বে রূপ দিচ্ছে না বা দেবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকে তাই ‘ডিপ স্টেটকে’ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উন্নত সংস্করণ মনে করছেন।

লেখক : সাংবাদিক 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর