Logo

মতামত

বাঙালির রাজনৈতিক অশ্লীলতা

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫১

বাঙালির রাজনৈতিক অশ্লীলতা

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য সবসময়ই চোখে পড়ে— সেটি হলো সুবিধাবাদ। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে দেখা গেছে, একাংশের রাজনৈতিক অবস্থান কখনোই স্থায়ী কোনো মতাদর্শের ভিত্তিতে দাঁড়ায়নি; বরং ক্ষমতার পালাবদল অনুযায়ী তাদের আনুগত্যও পাল্টেছে। যে দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসেছে, অনেকেই তার সঙ্গে আঁতাত করে সুবিধা আদায় করেছে। এই প্রবণতাই ধীরে ধীরে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে, যা এক কথায় রাজনৈতিক অশ্লীলতা।

বাংলার সমাজ আবেগপ্রবণ হলেও বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ায় অভ্যস্ত। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই দেখা গেছে, যারা ব্রিটিশ শাসকদের কাছাকাছি থাকতে পেরেছে, তারাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে। তখনকার অনেক জমিদার ও শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণি ব্রিটিশদের তুষ্ট করে ক্ষমতার অংশীদার হতে চেয়েছে। পাকিস্তান আমলেও একই প্রবণতা ছিল প্রবল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিংবা স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামে একাংশ নির্লিপ্ত থেকেছে, কিন্তু একই সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করে ব্যক্তিগত লাভের চেষ্টা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সুবিধাবাদীদের এই চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে— একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রেখেছে টিকে থাকার আশায়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও একই দৃশ্য স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। ৭০-এর দশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অনেকে তাদের অনুসারী হয়ে ওঠে। আবার ৮০-এর দশকে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সেই একই মানুষদের বড় অংশ শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারাও নতুন করে দলবদল করে। ৯০-এর দশকে গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা হলেও রাজনৈতিক অশ্লীলতার এই প্রবণতা থামেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। স্থানীয় থেকে জাতীয় রাজনীতির সবখানেই দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে ব্যবসা, চাকরি কিংবা সামাজিক প্রভাব খাটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, এমনকি সাংবাদিকরাও ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন।

এই রাজনৈতিক অশ্লীলতার পেছনে কয়েকটি বাস্তব কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে দলগুলো স্থায়ী আদর্শ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এত প্রবল যে, ক্ষমতাসীনদের ছায়া ছাড়া বড় কোনো সুযোগ তৈরি হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্রকে যেভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তাতে সাধারণ নাগরিক বাধ্য হয় ক্ষমতাসীনদের অনুসরণ করতে। তৃতীয়ত, বাঙালির ঐতিহাসিক চরিত্রে বেঁচে থাকার প্রবণতা বড় ভূমিকা রেখেছে— সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা পেতে হলে মানুষ ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

এ ছাড়া শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার ঘাটতিও বড় কারণ। অধিকাংশ মানুষ রাজনীতিকে নৈতিকতা বা আদর্শের জায়গায় না দেখে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের স্বার্থে মানুষকে বিভক্ত করে রাখে এবং দলবদলকারীদের জায়গা করে দেয়। এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও দেখা যায়, যিনি যে দল থেকে মনোনয়ন পান, তার চারপাশেই ভিড় জমে যায়। পরদিন যদি তিনি অন্য দলে যোগ দেন, সেই ভিড়ও আবার তার পিছু নেয়। এই প্রবণতা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।

এই রাজনৈতিক অশ্লীলতার নেতিবাচক প্রভাব ভয়াবহ। প্রথমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্থায়িত্ব আসেনি; দলবদল যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রকৃত যোগ্য ও নীতিবান মানুষ রাজনীতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে, কারণ তারা সুবিধাবাদী আঁতাতে রাজি হয় না। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হারিয়ে যাচ্ছে। নীতি বা জনগণের কল্যাণের বদলে অধিকাংশ মানুষ কেবল ক্ষমতার সঙ্গে থেকে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে চায়। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়, আর জনসাধারণের আস্থা ক্রমশ ক্ষয়ে যায়।

অতএব বলা যায়, বাঙালির রাজনৈতিক অশ্লীলতা কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, আজও বর্তমান। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নৈতিকতা ও আদর্শকে প্রাধান্য দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, দল ও রাষ্ট্রের আদর্শই মুখ্য হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, যাতে কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয়। শিক্ষা, সচেতনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমে নাগরিকদের দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে। অন্যথায় ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির আনুগত্যও বদলাতে থাকবে, আর জাতি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে আরও দূরে সরে যাবে।

লেখক : সংবাদকর্মী; নিজস্ব প্রতিবেদক, বাংলাদেশের খবর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর