পাহাড়ের কান্না ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোশ : তনু থেকে আজকের খাগড়াছড়ি
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪৩

প্রতীকী ছবি (এআই দিয়ে তৈরি)
রাত ৯টার দিকে প্রাইভেট পড়ার পর বাড়ি ফিরছিল খাগড়াছড়ির এক আদিবাসী কিশোরী। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই সে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয় একটি খেত থেকে। একজন কিশোরীকে ঘরে ফেরার পথে এভাবে অচেতন অবস্থায় পাওয়া কি কোনো সভ্য রাষ্ট্রে স্বাভাবিক?
আড়াল করার চক্র
কিন্তু বাংলাদেশে এসব অস্বাভাবিক নয়। কারণ এখানে ধর্ষণের পরও সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশে সেন্সরশিপ চলে, পুলিশ মামলা নিতে অনীহা দেখায়, ডাক্তারি পরীক্ষায় দেরি হয়, আলামত নষ্ট হয় এবং এজাহার এমনভাবে লেখা হয় যেন আসামি সহজেই জামিন পায়। ফলাফল—বিচার হয় না, অপরাধী বেঁচে যায়, নতুন অপরাধের পথ খুলে যায়।
তনু : বিচারহীনতার প্রতীক
২০১৬ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে সোহাগী জাহান তনুর লাশ পাওয়া যায়। পুরো বাংলাদেশ ভেবেছিল, এত আলোচিত ঘটনার বিচার না হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু হলো উল্টোটা—মেডিকেল রিপোর্ট পাল্টে গেল, তদন্ত ঝুলে রইল এবং বিচারহীনতার নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। এ কেমন রাষ্ট্রযন্ত্র!
মারমা মেয়েটির একই পরিণতি
একই চিত্র দেখা যায় মারমা মেয়েটির ক্ষেত্রেও। নির্যাতনের শিকার হলেও মেডিকেল রিপোর্টে দেখানো হলো— কোনো ধর্ষণের আলামত নেই। ভুক্তভোগীর কণ্ঠকেও রাষ্ট্রীয় যন্ত্র নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ধিক্কার এমন ব্যবস্থাকে।
খাগড়াছড়ির পুনরাবৃত্তি
আজ খাগড়াছড়ির আদিবাসী কিশোরীর ঘটনায় আমরা আবারও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। মহিলা কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত এক বছরে খাগড়াছড়িতে সাতজন পাহাড়ি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কয়জনের বিচার হয়েছে? উত্তর সবার জানা—‘শূন্য’।
রাষ্ট্র অপরাধীর পক্ষে
এখানে রাষ্ট্র ভুক্তভোগীর পাশে নেই, বরং অপরাধীর পক্ষে দাঁড়ায়। মামলা নেওয়ার অনীহা, দুর্বল চার্জশিট, প্রমাণ নষ্ট করা, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে মনে হয় যেন ভুক্তভোগীর নয়, অপরাধীর সঙ্গী।
আন্দোলনের আগুন
তাই বিস্ময় নেই যে পাহাড়ি জনগণ রাস্তায় নেমেছে। ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ রাজপথে দাঁড়িয়েছে, সড়ক অবরোধ করেছে, টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিরোধ গড়েছে। কারণ রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে নাগরিকেরা নিজেরাই লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়।
দ্বিগুণ নিপীড়নের শিকার আদিবাসী নারী
বাংলাদেশে নারী মানেই অবহেলা, আর আদিবাসী নারী মানেই দ্বিগুণ অবহেলা। একদিকে নারী হওয়ার কারণে বৈষম্য, অন্যদিকে জাতিগত পরিচয়ের কারণে নিপীড়ন। তাই তাদের উপর সহিংসতা কেবল যৌন নিপীড়ন নয়, এটি তাদের জাতিগত অস্তিত্বেরও আঘাত।
রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যানসার
প্রশ্ন হলো, একজন মেয়েকে অচেতন অবস্থায় ক্ষেতে ফেলে রাখা হলে সেটাকে আড়াল করা কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব? উত্তর হলো— হ্যাঁ, এই রাষ্ট্র তাই-ই করছে। পুলিশের ব্যর্থতা, চিকিৎসকদের ভুয়া রিপোর্ট, প্রশাসনের নীরবতা— সব মিলে রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে।
উপসংহার
বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানেই নতুন অপরাধকে উৎসাহ দেওয়া। তনুর বিচার হয়নি, তাই আজ পাহাড়ের কিশোরীরা ধর্ষিত হচ্ছে। মারমা মেয়েটির রিপোর্ট পাল্টে দেওয়া হয়েছে, তাই অপরাধীরা আজও নিশ্চিন্তে ঘুরছে।
রাষ্ট্র যদি আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে রাষ্ট্র নিজেই তাদের নিপীড়নের সহায়ক। আজ পাহাড় কাঁদছে। এই কান্না শুধু এক কিশোরীর নয়, একটি জাতির কান্না। আর রাষ্ট্রের এই অমানবিক নীরবতা আমাদের সবার জন্য লজ্জা, আমাদের সবার জন্য হুমকি।
এমএইচএস