ঢাবিতে শ্রেণি বিদ্বেষের বীজ, হকার উচ্ছেদের নামে ‘মানবতার অপমান’
 
						জওয়াদুল করিম
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:২০
 
					ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও গণআন্দোলনের গর্বিত কেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন ছিল নিপীড়িতের পক্ষে, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক। কিন্তু আজ, সেই একই প্রাঙ্গণে আমরা দেখি উল্টো এক চিত্র। ‘পরিচ্ছন্নতা” বা “শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা’-র নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু এলিট শিক্ষার্থী ও কতৃপক্ষ মিলে হকারদের উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে- যেভাবে তা করা হচ্ছে, তা কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং এক গভীর শ্রেণি বিদ্বেষের প্রকাশ।
যে মানুষগুলো প্রতিদিন এই প্রাঙ্গণের গেটে দাঁড়িয়ে চা বিক্রি করে, পিঠা-পানীয় বিক্রি করে, কিংবা কয়েকটি বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে- তারা এই সমাজেরই অংশ। তারা ঢাবির মাটিরই সন্তান, এই শহরের প্রাণ। অথচ আজ তাদের দিকে তাকানো হচ্ছে ‘অবাঞ্ছিত’ বা ‘অশোভন’ হিসেবে। তাদের আয়ের উৎস বন্ধ করে দেওয়া, দোকান উল্টে দেওয়া, এমনকি কখনো চড়-থাপ্পড় বা গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া- এসব কোনোভাবেই সভ্য আচরণ নয়। এটি যেন সেই পুরোনো জমিদারি শোষণেরই নয়া রূপ, যেখানে শক্তিমানরা দুর্বলকে অপমান করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে।
রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘যে মানুষ নিজের জন্যে কিছু চায় না, সে-ই মানুষের জন্যে সব চায়।’ ঢাবির ইতিহাস তো সেই মানবিক চেতনারই উত্তরাধিকারী। কিন্তু আজ সেখানে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো এক প্রবণতা- যেখানে শক্তি ও প্রভাব দেখানো হচ্ছে দুর্বলদের উপর।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘আমি সেই দিন মানব হব, যেদিন মানুষের দুঃখে ব্যথিত হব।’ অথচ আজ যে মানুষগুলো ঢাবির গেটে দাঁড়িয়ে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের চা, বিস্কুট, ঝালমুড়ি বা ফুচকা বিক্রি করে নিজেদের জীবন চালিয়েছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে এমন ভাষা ও ভঙ্গিতে- যা শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং চরম শ্রেণি বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ।
অথচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোতে হকার, টং দোকানি ও ভবঘুরে মানুষের ভূমিকাও অপরিসীম। ২৪ এর অভ্যুত্থানে সহ যুগে যুগে যখন শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমেছিল, তখনই এই মানুষগুলো তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার নিদর্শন রেখেছে। তাদের উপস্থিতি আন্দোলনকে শক্তি দিয়েছে, এবং অনেক সময় তারা আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
তবে, তাদের এই অবদান কখনোই যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি। বরং, উল্টো তাদেরকে 'মাদকসেবি' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি একটি গভীর শ্রেণি বৈষম্যের প্রকাশ, যা আমাদের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি এক চরম আঘাত।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- এই হকার ও টং দোকানিদের ঢালাওভাবে ‘মাদকসেবী’ বা ‘মাদকব্যবসায়ী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই মানসিকতা যেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন, তেমনি বিপজ্জনকও। কিছু চিহ্নিত অপরাধী থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হতো, প্রশাসনকে অবহিত করে তাদের আটক করাই হতো দায়িত্বশীল পদক্ষেপ। রাষ্ট্র-সমাজে কিংবা ক্যাম্পাসে প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করা, আটক করার ক্ষমতা প্রশাসনের হাতে, সেখানে ছাত্রনেতারা নিজেরা হয়ে উঠছেন ‘বিচারক’ নিজেরাই প্রশাসন। পুরো একটি শ্রমজীবী শ্রেণিকে কলঙ্কিত করা কেবল অহংকার ও অক্ষমতার মিশ্র প্রতিফলন।
আর এখানেই ফ্রিদরিখ নীৎসের সেই সতর্কবাণী যেন বাস্তব হয়ে ওঠে- ‘Whoever fights monsters should see to it that he does not become a monster in the process.’ (‘অন্যায় দূর করতে গিয়ে যেন নিজেরাই অন্যায় না করি’)
ঢাবির দীর্ঘদিনের আড্ডা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই টং দোকানগুলো। সস্তা চায়ের কাপ, বিস্কুটের প্যাকেট, ঝালমুড়ি কিংবা ফুসকার আসরে বসেই ছাত্ররা আলোচনা করত- সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, প্রেম আর রাজনীতি নিয়ে। এই জায়গাগুলোই ছিল মুক্তচিন্তার প্রাণকেন্দ্র। আজ সেই আসরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, আর তার জায়গা নিচ্ছে দামি রেস্টুরেন্ট, কফি কর্নার, আর তথাকথিত ‘ফুড সিন্ডিকেট’। এটি নিছক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা নয়; বরং পুঁজিবাদী এলিট শ্রেণির ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষা ও গরিব মানুষের জীবিকা ধ্বংসের এক কৌশল।
এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয়- যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদেরকেও এখন ‘মাদক দালালের দোসর’ বা ‘অপরাধী পক্ষের সমর্থক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ভিন্নমতের মানুষকে অপরাধী বানিয়ে দমন করার এই প্রবণতা কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশের লক্ষণ নয়; বরং এটি এক ধরনের স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রতিফলন যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যুক্তি, বিতর্ক ও মানবতার চর্চা; সেখানে ভিন্নমতকে অপরাধ হিসেবে দেখার প্রবণতা শিক্ষা ও নৈতিকতার মূলকেই ধ্বংস করে এবং সেখানে এখন ভয়, অপবাদ আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এটি কেবল হকার উচ্ছেদ নয়; এটি এক মানুষ উচ্ছেদ। এটি সেই রাজা-প্রজার মানসিকতার পুনরুত্থান, যা মুক্তচিন্তা ও সমতার শিক্ষালয় ঢাবির চেতনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যে বিশ্ববিদ্যালয় একসময় শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলত, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাঙ্গণে ‘উচ্চবিত্ত’ মানসিকতার শিক্ষার্থীরা গরিব মানুষকে অবমাননা করছে- এটি এক ভয়াবহ সামাজিক সংকেত।
মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, ‘The true measure of any society can be found in how it treats its most vulnerable members.’ (সমাজে দুর্বল মানুষদের প্রতি আচরণই সভ্যতার আসল মাপকাঠি)
ঢাবির এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে- আমরা কেমন সমাজ গড়ছি? এমন এক সমাজ, যেখানে দুর্বলকে সরিয়ে শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়?
ঢাবি কেবল জ্ঞানচর্চার জায়গা নয়; এটি বাংলাদেশের নৈতিক দিকনির্দেশনা তৈরির স্থান। এখানকার শিক্ষার্থীরা একসময় রাজপথে নেমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, রক্ত দিয়েছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। আজ সেই একই ক্যাম্পাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে বরং অন্যায়ের পক্ষ নেওয়া- এটি আত্মপরিচয়ের এক ভয়াবহ পতন নয় কি?
যদি ঢাবির ছাত্ররা শ্রেণি বৈষম্যের দেয়াল আরও উঁচু করে তোলে, তাহলে তারা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি তার জনমানুষের সংযোগেই নিহিত। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, দরিদ্রের প্রতি অসংবেদনশীল, আর প্রশাসনিক অহংকারে ভরপুর একটি এলিট বৃত্ত কখনও সমাজের পথপ্রদর্শক হতে পারে না।
ঢাবিতে হকার উচ্ছেদের এই অমানবিক কর্মসূচি কেবল কিছু মানুষের রুজির উপর আঘাত নয়—এটি ঢাবির আত্মার উপরও আঘাত। এই বিশ্যব বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি অহংকার, শ্রেণি বৈষম্য ও মানবতা-বিবর্জিত আচরণ প্রতিষ্ঠা পায়, তবে এটি কেবল একটি প্রজন্মের ব্যর্থতা নয়- এটি এক আদর্শের মৃত্যু। আজ দরকার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ, দরকার এক নতুন মানবিক সংলাপ- যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় আবারও হয়ে উঠবে জনমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়।
শেষে মনে পড়ে যায় পাবলো নেরুদার কথাগুলো- ‘You can cut all the flowers but you cannot keep spring from coming.’
ঢাবির এই প্রাঙ্গণেও সেই বসন্ত একদিন ফিরে আসবেই- যেদিন মানবতা, সমতা আর সহমর্মিতা আবারও জায়গা করে নেবে শ্রেণি, জাত ও পদমর্যাদার ঊর্ধ্বে।
ঢাবিকে তার জনগণের পাশে ফিরতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল শক্তি তার প্রাচীরের ভেতরে নয়, বরং তার শিক্ষক-শিক্ষার্থী কর্মচারী এবং আশপাশের মানুষ। হকারদের চোখের অশ্রু যেন আমাদের বিবেকের আয়নায় প্রতিফলিত হয়।
কারণ, ঢাবি যদি মানবতা হারায়, তবে গোটা জাতিই দিশা হারাবে।
লেখক : তরুণ সংগঠক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
আইএইচ/


 
			