আশুলিয়ায় রাতভর সংঘর্ষ
শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক অবক্ষয় ও ভবিষ্যতের সংকট
 
						রাফায়েল আহমেদ শামীম
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৫
-6902dabb20958.jpg) 
					রোববার রাত, ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় ঘটে গেল এমন এক ঘটনা, যা শুধু দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, বরং দেশের শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার গভীর সংকটের প্রতিফলন। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে। এতে আহত হয়েছে শতাধিক শিক্ষার্থী, ১১ জন জিম্মি রাখা হয়েছে, এবং প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্যাম্পাসের গাড়ি, ভবন, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, কম্পিউটার-সবই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত একটি তুচ্ছ ঘটনায়-এক সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী যখন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর গায়ে থুতু ফেলেছিল। সাধারণ পরিস্থিতিতে এটি হয়তো সামান্য ঘটনা হিসেবেই শেষ হতে পারত। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এটিকে আক্রমণ বা অসম্মানের মতো গ্রহণ করে, যা কথাকাটাকাটির মাধ্যমে উত্তেজনার জন্ম দেয়। পরবর্তী সময়ে মারধর, প্রতিশোধ এবং দলবদ্ধ সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। এই ছোটখাটো ঘটনা প্রমাণ করে যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা ও সামাজিক নৈতিকতার অভাব কতটা প্রকট।
রাতে সংঘর্ষের সময় ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক ভবন, উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও ট্রেজারারের অফিসে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক উধাও হয়, ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার ভেঙে ফেলা হয়, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং নথিপত্র লুট করা হয়। সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে অন্তত ১৩টি গাড়ি পুড়ে যায়। শিক্ষাঙ্গনে পরিকল্পিতভাবে সংঘর্ষ চালানোর এই ঘটনা প্রমাণ করে, শিক্ষার্থীরা শুধু ক্ষোভপ্রবণ নয়, বরং সংগঠিতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিও এই সংঘর্ষকে আরও ভয়াবহ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল সীমিত এবং কার্যকরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এটি দেখায়, দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা শিক্ষাঙ্গনের সহিংসতা মোকাবেলায় প্রায়শই অক্ষম। যখন শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের নির্দেশ এবং আইনকে উপেক্ষা করে, তখন শিক্ষাঙ্গনের অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি এক নতুন মাত্রা পায়।
এই ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক অবক্ষয়ও স্পষ্ট হয়েছে। যারা দেশের ভবিষ্যত নেতা ও পেশাজীবী, তারা ছোটখাটো দ্ব›দ্বকেও বড় সংঘর্ষে রূপ দিতে সক্ষম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা, ধৈর্য্য এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব ভবিষ্যতের জন্য একটি গভীর সতর্কবার্তা। ছোটখাটো উত্তেজনা শিক্ষাঙ্গনের মধ্যে সহিংস প্রতিক্রিয়ায় রূপ নিলে শুধু শিক্ষার্থীর জীবন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ও সামাজিক পরিবেশও বিপন্ন হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাও উল্লেখযোগ্য। সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক লুৎফর রহমান জানিয়েছেন, হামলা ও অগ্নিসংযোগের কারণে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনই দেশের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। যখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যেই এই সম্পদকে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার করে, তখন দেশের মানসিক, নৈতিক ও আর্থিক সম্পদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দায়-দায়িত্ব নির্ধারণেও জটিলতা দেখা দেয়। ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা মূলত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও সংঘর্ষের সূত্রপাত সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর তুচ্ছ আচরণের সঙ্গে যুক্ত। এটি প্রমাণ করে, শিক্ষাঙ্গনে নৈতিক ও সামাজিক নির্দেশনার অভাব কিভাবে ছোটখাটো ঘটনার মধ্যেও বিশাল বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবকরা যথাযথ হস্তক্ষেপ না করলে, এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
সংঘর্ষের পর শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষ আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা রাত ১২টার পর প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ভাঙচুর চালায়। এটি দেখায়, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রভাব সীমিত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা ও প্রতিশোধের প্রবণতা কতটা প্রকট। শিক্ষাঙ্গনে সাংগঠনিক ও নৈতিক দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের সহিংসতা বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া সামাজিক দিক থেকেও এটি উদ্বেগজনক। সংঘর্ষের সময় আশেপাশের এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ককটেল বিস্ফোরণ, আগুন, লুটপাট-এসব ঘটনার কারণে স্থানীয় মানুষও নিরাপদ নয়। শিক্ষাঙ্গন শুধু নিজেরই নয়, আশেপাশের সমাজের নিরাপত্তার জন্যও দায়বদ্ধ। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা সামাজিক পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
এই সংঘর্ষ প্রমাণ করে, শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা শুধু শিক্ষার্থীর আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অক্ষমতার প্রতিফলন। শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা ও নৈতিক নির্দেশনার অভাব শিক্ষার্থীদের সহিংস প্রতিক্রিয়ায় উৎসাহ দেয়।
শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা দেশের নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিকেও আঘাত হানছে। শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ-যদি তাদের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাব থাকে, তাহলে দেশের ভবিষ্যতও ঝুঁকির মুখে। শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন এবং রাষ্ট্র-সকলকে একত্রিতভাবে শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক মানদণ্ড, সামাজিক শিক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের স্থান হিসেবে দেখা যাবে না। এটি নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক ও প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে শিক্ষাঙ্গন শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে গড়ে ওঠে।
ড্যাফোডিল ও সিটি ইউনিভার্সিটির সংঘর্ষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেশের জন্য একটি গভীর সতর্কবার্তা। শিক্ষার্থীরা দেশের সম্পদ-যদি তারা নিজেদের মধ্যেই সম্পদ ধ্বংস করে, তবে জাতির ভবিষ্যতও বিপন্ন হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা কার্যকরভাবে বজায় রাখতে হবে। শিক্ষাঙ্গন যদি শান্তিপূর্ণ, নৈতিক ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে গড়ে ওঠে, তখনই দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম হবে নৈতিক, দায়িত্বশীল ও দক্ষ নাগরিক। সাভারের আশুলিয়ার এই ঘটনা আমাদের শেখায়-শিক্ষাঙ্গনকে শুধু জ্ঞান অর্জনের স্থান নয়, নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্র হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় শিক্ষাঙ্গনের সহিংসতা দেশের ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে।
সমাধানের জন্য প্রয়োজন:
১. প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করা: শিক্ষক, প্রশাসন ও প্রভোস্টদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সংঘর্ষের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে হবে।
২. শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা: সহমর্মিতা, ধৈর্য্য, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং শান্তিপূর্ণ দ্ব›দ্বসমাধানের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. আইনশৃঙ্খলা কার্যকর করা: শিক্ষাঙ্গনের আশেপাশে পুলিশি প্রহরা ও দ্রুত হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সামাজিক ও মানসিক সহায়তা: আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দেওয়া এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা।
৫. অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একে অপরের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ এবং ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করবে।
শেষ কথা, শিক্ষাঙ্গন শুধুমাত্র জ্ঞান আহরণের স্থান নয়। এটি দেশের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার কেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যত, তাই তাদের মধ্যে সহমর্মিতা, ধৈর্য্য, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক মানদণ্ডের বিকাশ অপরিহার্য। সাভারের আশুলিয়ার এই দুঃখজনক ঘটনা আমাদের সতর্ক করে দেয়-যদি শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল থাকে, তবে দেশের ভবিষ্যতও বিপন্ন। তাই শিক্ষক, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও অভিভাবক-সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষাঙ্গনকে শান্তিপূর্ণ, নৈতিক ও নিরাপদ স্থানে রূপান্তরিত করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা।
বিকেপি/এমবি


 
			