গণভোটের ছায়া : নির্বাচনের আগে অপ্রয়োজনীয় এক রাজনৈতিক প্রহসন
অরণ্য পাশা
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৬
জুলাই সনদ নিয়ে হ্যাঁ-না ভোটের প্রশ্ন আজ দেশের রাজনীতির এক নতুন মোড় ঘুরিয়েছে। অনেকে একে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের অনুশীলন হিসেবে দেখছেন। আবার অনেকে মনে করছেন এটি মূলত রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। যার উদ্দেশ্য জনগণের মতামতের আড়ালে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা। সনদটি ঘোষণার পর থেকেই দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক- এটি কি সত্যিই জনতার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথ? নাকি একটি নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক নাটক?
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে একটি গণভোট আয়োজন করা উচিত। কমিশন একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নও প্রস্তাব করেছে- ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
এই প্রশ্নটি ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবকে একত্রে বেঁধে ফেলেছে, যা ভোটারদের কাছে বিভ্রান্তিকর ও অগণতান্ত্রিক। কারণ, এতে জনগণকে একসাথে সব প্রস্তাবেই হ্যাঁ বা না বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি একধরনের জগাখিচুড়ি, যা জনমতের সঠিক প্রতিফলন নয় বরং কৃত্রিম ঐকমত্যের প্রচেষ্টা।
বিএনপি প্রথম থেকেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচনের আগে গণভোট কোনোভাবেই মেনে নেবে না বিএনপি। তার মতে, এটি অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন, নির্বাচনের আগে গণভোট নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। বিএনপি মনে করে, গণভোটের এই প্রস্তাব মূলত নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করার এক পরিকল্পিত ফাঁদ।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কয়েকটি ছোট দল যেমন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস প্রভৃতি নভেম্বরে গণভোটের দাবি তুলেছে। তারা যুক্তি দিচ্ছে, সংবিধান সংস্কার বিলম্বিত হলে রাজনৈতিক স্থবিরতা বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই দাবির পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থই মুখ্য। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রকাশ্যেই বলেছেন, নির্বাচন সময়মতো না হলেও গণভোট হতে হবে। এটি গণতন্ত্র নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচন আয়োজন নিজেই এক বিশাল প্রশাসনিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ। গণভোট আলাদা দিনে হলে খরচ দ্বিগুণ হবে। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা জেসমিন তুলি গণমাধ্যমে বলেছেন, গণভোটের জন্য যে লজিস্টিকস প্রয়োজন, তা নির্বাচনের মতোই। এতে নির্বাচন কমিশনের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে, যখন ডলার সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলেছে, তখন গণভোট আয়োজন নিছক বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সতর্ক করে বলেছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিলম্ব ব্যবসায়িক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাই সময়মতো নির্বাচনই দেশের অর্থনীতির জন্য জরুরি।
আইনি দিক থেকেও গণভোটের প্রস্তাব দুর্বল। সংবিধানে জাতীয় পর্যায়ের গণভোটের কোনো সরাসরি বিধান নেই। গণভোট আয়োজনের আগে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যা নিজেই একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। ফলে এটি নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত করার ঝুঁকি তৈরি করবে। বাস্তবে, গণভোট আয়োজনের নামে প্রশাসনিক প্রস্তুতি, ব্যয় ও আইনগত প্রক্রিয়া মিলিয়ে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াই বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।
আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন হলো- এই গণভোট আদৌ জনগণের মতামত প্রতিফলিত করবে কি না। যখন ৪৮টি সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব একত্রে ভোটের সামনে রাখা হয়, তখন মানুষ প্রকৃতপক্ষে জানে না, কোন প্রস্তাবে সে ‘হ্যাঁ’ বলছে আর কোনটিতে ‘না’। এটি এক ধরনের ‘ব্লাইন্ড ভোটিং’, যা গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থী। গণভোটের সরল ‘হ্যাঁ-না’ কাঠামো জটিল সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে জনমত বিকৃত করে।
স¤প্রতি নির্বাচন কমিশনের সামনে জামায়াত ও তাদের মিত্রদের গণভোট দাবিতে সমাবেশ রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, গণভোটের প্রশ্ন শুধু রাজনৈতিক নয়। এটি আইনশৃঙ্খলাজনিত ঝুঁকিও তৈরি করছে। এখন যখন জাতীয় রাজনীতিতে সংলাপ, ঐক্য ও আস্থার প্রয়োজন। তখন গণভোটের মতো বিতর্কিত উদ্যোগ কেবল বিভাজনকেই তীব্র করবে।
গণতন্ত্রের শক্তি আসে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে। গণভোটের মতো একমুখী প্রক্রিয়া জনগণের মতামত নয়। বরং একদলীয় সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়ার উপায় হয়ে দাঁড়ায়। গণভোট এখন কোনো বাস্তব প্রয়োজন নয়; এটি কেবল রাজনীতিকে নতুন বিতর্কে ঠেলে দিচ্ছে।
এখন বাংলাদেশের জনগণ চায় একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সময়মতো নির্বাচন। যেখানে তাদের ভোটের মূল্য থাকবে, আস্থা ফিরে আসবে গণতন্ত্রে। নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন মানে সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক শক্তির অপচয়। এটি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাবে, এবং রাজনৈতিক বিভাজন গভীর করবে। তাই বলা যায়, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন গণতন্ত্র নয়, বরং প্রহসন। এটি দেশকে এগিয়ে নেবে না, বরং অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।
গণভোট যদি হয়ই, তবে তা হওয়া উচিত জাতীয় নির্বাচনের পর। নির্বাচিত সরকার সংসদে গিয়ে জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর মতামত ও নিজ দলের ভিন্নমত বিবেচনায় সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস করে রাষ্ট্রপতির সইয়ের আগে গণভোট আয়োজন করতে পারে।
ঐকমত্য কমিশন বহু পরিশ্রমে যে জুলাই সনদ তৈরি করেছে, তা এখন গণভোট ইস্যুতে এসে জটিলতার মুখে পড়েছে। প্রস্তাবিত গণভোট বাস্তবে ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না; বরং এটি এক ধরনের জগাখিচুড়ি সমাধান তৈরি করছে।
রাজনৈতিক বিরোধ বাড়তে থাকলে গণভোটের প্রতি জনগণের আগ্রহ কমবে, উপস্থিতিও হবে কম। কোনো পক্ষ বর্জন করলে পরিস্থিতি আরো সংকটময় হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন বিতর্কিত গণভোট জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
লেখক : অরণ্য পাশা, সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী
বিকেপি/এমবি

