বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো এখন আর নিরাময়ের কেন্দ্র নয়, বরং পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর মানবিক অবমাননার এক ভয়ংকর চক্রে। হাসপাতালের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের ভেতরের চিত্র—সবখানে বিরাজ করছে চরম নৈরাজ্য।
এই অনিয়মের শুরু হয় হাসপাতালের গেট থেকেই। জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্স থামার আগেই দালালরা ঘিরে ধরে রোগীর স্বজনদের। “ভালো চিকিৎসা চান? আমাদের সঙ্গে চলুন। ”এই ‘ভালো চিকিৎসা’ মানে মূলত ঘুষ দিয়ে ডাক্তার দেখানো, ওয়ার্ডে জায়গা পাওয়া, কিংবা অপারেশনের তারিখ এগিয়ে আনা ইত্যাদি। সুস্থ হয়ে রিলিজের সময়ও নানা অজুহাতে অর্থ আদায় করে থাকে তারা। বরাদ্দকৃত খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রায়শই রোগীদের হাতে পৌঁছায় না। প্রেসক্রিপশনে সরকারি ওষুধের নাম থাকলেও রোগীকে বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য করা হয়। কারন, হাসপাতালের ভেতরে একটি অদৃশ্য চোরাচালান চক্র সক্রিয়, যারা ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেয়। বরাদ্দের অর্ধেক খাবার চুরি হয়।
ওয়ার্ডে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে আরেক বাস্তবতা। রোগী গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। মেঝেতে শুয়ে থাকা রোগীর সংখ্যা বেডে থাকা রোগীর চেয়ে কয়েকগুন বেশি। রোগীর যতœ নেওয়ার জন্য স্বজনের উপস্থিতি জরুরি, একজন রোগীর সঙ্গে সাধারণত ১-২ জন স্বজন থাকেন, কিন্তু সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে তাদের জন্য কোনো আলাদা জায়গা নেই। স্বজনরা মেঝেতে, করিডোরে, সিঁড়িতে রাত কাটান—অনেক সময় খাবার, পানি বা টয়লেট ব্যবহারের সুযোগও পান না। বাতাসে ভেসে বেড়ায় প্রস্রাব, পচা রক্ত আর ওষুধের গন্ধ। নার্সদের মুখে বিরক্তি, ডাক্তারদের চোখে ক্লান্তি, আর রোগীদের চোখে এক ধরনের আত্মসমর্পণ।
কর্তব্যরত অনেক ডাক্তার সকালবেলা সই করে চলে যান প্রাইভেট চেম্বারে। সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখেই ডাক্তাররা বলেন “ক্লিনিকে আসেন, ওষুধ দেখাই”। আবার, রোগীকে নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয় কমিশনের বিনিময়ে। চিকিৎসকদের কেউ কেউ আছেন আন্তরিক, কিন্তু তারা সংখ্যায় কম, আর সিস্টেমে বন্দী। একজন ডাক্তারকে দিনে ৫০-৬০ জন রোগী দেখতে হয়, কখনো তার বেশি। এই চাপের মধ্যে মানবিকতা হারিয়ে যায়, পেশাদারিত্ব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রোগীর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই, ব্যথা বোঝার সময় নেই, কেবল প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়া। রোগী যদি প্রশ্ন করে, “স্যার, এটা কী রোগ?”—তখনই মুখে ভেসে ওঠে বিরক্তি। যেন প্রশ্ন করাটাই অপরাধ। আর নার্সিং সেবার কথা বললে, সেখানে তো অবমাননার এক নতুন অধ্যায়। নার্সরা অনেক সময় রোগীর সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন তারা কোনো অপরাধী। “চুপ করে থাকেন, বেশি কথা বলবেন না”—এই ধরনের বাক্য প্রতিদিন শত শত রোগী শুনেন। প্রসূতি মায়েরা, বৃদ্ধ রোগীরা, শিশুদের মা—সবাই এই অবমাননার শিকার।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থাও ভয়াবহ। টয়লেটগুলো ব্যবহারযোগ্য নয়, ওয়ার্ডে ময়লা জমে থাকে দিনের পর দিন, ইনফেকশন ছড়ায় অনায়াসে। রোগীরা নিজের বিছানার নিচে পচা খাবার, রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যান। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়মিত হাজির হন না, আর যারা আসেন, তারা কাজ করেন ‘টিপস’ এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, টাকা দিলে পরিষ্কার হবে, না দিলে রোগী নিজেই গন্ধ সহ্য করবে। দেশের মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার চূড়ান্ত চিত্রটি সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া কিছু ছবিতে আক্ষরিক অর্থেই মূর্ত হয়ে উঠেছে, যেখানে ময়মনসিংহের তিনবার দেশসেরার খ্যাতি পাওয়া একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের শয্যায় শুয়ে থাকা রোগীর পাশে কুকুরদল নির্দ্বিধায় সহাবস্থান করছে। কুকুরের দল যেন হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে এসেছে, এমনকি গরুও রোগীর সাথে হেঁটে হাসপাতালে ঢুকছে—যেখানে মানুষের জন্য ঠাঁই মেলে না, সেখানে জীবজন্তুর অবাধ বিচরণ কীসের ইঙ্গিত দেয়? এই দৃশ্য কেবল অপরিচ্ছন্নতার প্রতীক নয়; এটি একটি গভীর বার্তা বহন করে: রাষ্ট্রের চোখে এই অসহায় মানুষগুলোর মূল্য ঐ বেওয়ারিশ প্রাণীর চেয়ে বেশি নয়। যখন ‘কুকুরের মতো নিকৃষ্ট আচরণ’ রূপকটি হাসপাতালের মেঝেতে আক্ষরিক সত্য হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, আমরা ঠিক কোন মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।
এই অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো রোগীর মর্যাদাহানি। একজন দরিদ্র রোগীকে অনেক সময় এমনভাবে তুচ্ছ করা হয়, যেন তার জীবন মূল্যহীন। “বেড নাই, বাইরে যান”, “এই রোগী তো মরেই যাবে”—এই ধরনের বাক্য কেবল অবহেলা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা। রোগী মারা গেলে তার লাশ হস্তান্তরেও নানা জটিলতা তৈরি হয়—যা পরিবারকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা বা দুর্নীতির শিকার হলে তার জন্য কোনো কার্যকর আইনি সহায়তা নেই। অভিযোগ উঠলে তদন্ত হয় না, বরং ‘দুর্ভাগ্যজনিত মৃত্যু’ বলে দায়সারা করা হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক ও বিপজ্জনক দিকটি হলো, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) মায়ের চিকিৎসা করাতে যাওয়া এক ছাত্র যখন হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছিলেন, তখন তিনি যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, তা শিহরণ জাগায়। অভিযোগের পর আনসার সদস্য ও হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক মিলে তাকে লাঠি, রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধর করে অজ্ঞান করেন। এমন ঘটনা প্রমাণ করে, হাসপাতালে দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহার কেবল অনিয়ম নয়, এটি একটি সুরক্ষিত সংস্কৃতি—যেখানে সেবা প্রদানকারীর ভূমিকা পালনকারীরাই নির্যাতনের হাতিয়ার হন।
সিটি স্ক্যান, ডায়ালাইসিস, অক্সিজেন প্ল্যান্ট, এক্স-রে মেশিন ইত্যাদি প্রায়শই নষ্ট থাকে, মেরামত হয় না বা কারিগরি জনবলের অভাব, এই অব্যবস্থাপনা–মূল দুষ্টচক্রের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচজন হেলথ টেকনোলজিস্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশে বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৪০ হাজার চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও, সেই অনুপাতে ২ লাখ হেলথ টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৫ হাজার জন। এই চরম ঘাটতির কারণে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে এক্স-রে, প্যাথলজিসহ অত্যাবশ্যকীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর ধরে বাক্সবন্দি বা অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এখানেই দুর্নীতির জটিল সমীকরণটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর গবেষণা অনুযায়ী, সারাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নতুন কেনা প্রায় ৪০ শতাংশ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। খুলনার একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দশ বছর ধরে পড়ে ছিল, আর বরিশালের একটি কোবাল্ট মেশিন নয় বছর ধরে মেরামত ছাড়াই অকেজো হয়ে আছে।
দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত একটি শক্তিশালী চক্রের ইন্ধনে এসব উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়ম করা হয়, যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়। কিন্তু ঐ যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় হেলথ টেকনোলজিস্ট নিয়োগে থাকে অদৃশ্য অনীহা। এই অনীহা ইচ্ছাকৃত। কারণ সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি অচল থাকলে এবং ওষুধ থাকা সত্ত্বেও তা রোগীদের না দিয়ে বাইরের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা হলে, রোগীরা অনিবার্যভাবে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য হন। এই বাধ্যতামূলক বহির্গমন দালালচক্রকে উৎসাহিত করে, যারা রোগীদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন লাভ করে। অর্থাৎ, জনবল নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকারি সেবাকে অকার্যকর করে রাখার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ চক্র সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করছে এবং একই সঙ্গে বেসরকারি ব্যবসাকে প্রচ্ছন্ন ভর্তুকি দিচ্ছে। এই ভয়াবহ চক্রের কারণে স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থ অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে বাজে অপচয় হয় ।
স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা যেন কেবল একটি করুণার বিষয় না হয়, বরং তা যেন মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়–সেই নিশ্চয়তা দিতে না পারলে জাতির মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়বে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিকেপি/এমবি

