Logo

মতামত

গবেষণায় পিছিয়ে : চাকরিমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগে কী লাভ

Icon

অলোক আচার্য

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯

গবেষণায় পিছিয়ে : চাকরিমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগে কী লাভ

একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ধারা ঠিক করে সেই দেশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারক কেমন হবে। এই যে আমাদের দেশে এত ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে এর মধ্যে দেশের কিশোর থেকে যুবক কাউকে কি স্বপ্ন দেখাতে পারছে? এক সময় স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড় কোনো চাকরি করবে। এখনও কি সেটাই চায় সকলে? এখন আপনি যদি ক্লাসে যান তাহলে এই ধরনের উত্তর দেওয়ার কিশোর, তরুণকে খুঁজে পাবেন খুব কম। কেউ কেউ হঠাৎ শিখিয়ে দেওয়া কথা বলবে তবে বাকিরা নিশ্চুপ। কারণ ওরা তো জানেই না যে তাদের স্বপ্নটা আসলে কি! এটাই আশ্চর্যের! পড়লেই যে চাকরি হয় না বা হচ্ছে না সে তো আর এখন নতুন করে বলার নেই। চারদিকে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার ঘুরছে। আবার চোখের সামনেই টাকা উপার্জনের শর্টকাট পদ্ধতিও ঘুরছে। যারা লেখাপড়া করেছে তাদের থেকেও সেই শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন করা মানুষগুলো বেশি অর্থ উপার্জন করছে। 

বর্তমানে অধিকাংশ ছেলেমেয়ের মথায় ঘুরছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার শখ, আমি এই শখকে খারাপ বলছি না তবে পড়ালেখার টেবিল বাদ দিয়ে কনটেন্ট তৈরিতেই ব্যস্ত থাকছে এবং এটা তো অবশ্যই খারাপ। আমাদের চোখের সামনেই কনটেন্ট তৈরি করে ডলার আয়ের বিজ্ঞাপন ভেসে বেড়াচ্ছে! সেই লোভে তো অপমৃত্যু নিশ্চিত! আবার ফিরে আসি শিক্ষায়। শিক্ষা ও গবেষণা পরস্পর সহক্রম বিষয়। যে বিষয়ে যত বেশি গবেষণা হবে সেই বিষয়ে অগ্রগতি তত বেশি হবে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশে গবেষণা কার্যক্রম খুব কম। মানে গবেষণা করার মতো এত ধৈর্য বা সময় কারও নেই। বিশ্ব র‌্যাংকিং সে কথাই বলছে। জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন-ডব্লিউআইপিও)। ইনপুট সূচক পাঁচটি  স্তম্ভে (প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, মানবসম্পদ ও গবেষণা, অবকাঠামো, বাজারের আধুনিকায়ন এবং ব্যবসায়িক দক্ষতা) উদ্ভাবনকে সক্ষম করার উপাদান মূল্যায়ন করে। অন্যদিকে আউটপুট সূচক দুটি স্তম্ভে (জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতা) উদ্ভাবনী কর্মকান্ডের ফলাফল পরিমাপ করে। 

গত ১৬ সেপ্টেম্বর গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স-জিআইআই সূচকের ১৮ তম সংস্করণ প্রকাশ করে। গবেষণা ও উদ্ভাবন সূচকে বিশ্বের ১৩৯ টি দেশের মধ্যে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। গত বছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একই ছিল। বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে এ সূচকে অগ্রগতি করেছে কেনিয়া, ঘানাসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ। প্রকাশিত সূচকে ঘানা ১০১ তম, কেনিয়া ১০২তম স্থানে রয়েছে। এছাড়া আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজেরিয়ার অবস্থান ১০৫ তম। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শুধুমাত্র নেপালের চেয়ে ওপরে রয়েছে।

জিআইআই সূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশ বেশ এগিয়েছিল। সে বছর এক লাফে ১৪ ধাপ অগ্রগতি করে ১০২ তম অবস্থানে উঠে আসে। পরের বছরই পিছিয়ে পড়ে ১০৫ তম স্থানে নেমে যায়। ২০২৪ সালে আরও এক ধাপ পিছিয়ে অবস্থান দাঁড়ায় ১০৬ তম। এর আগে টানা চার বছর বাংলাদেশ ১১৬ তম স্থানে ছিল। সাময়িক অগ্রগতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়াই এ খাতে স্থায়ী ভিত্তি গড়ে তুলতে না পারার প্রমাণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, শীর্ষ স্থানে থাকা সুইজারল্যান্ড ১০০ এর মধ্যে ৬৬ পয়েন্ট পেয়েছে। দেশটি টানা ১৫ বছরের মতো প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে। সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে এবং সিঙ্গাপুর রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে। এরপর রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও প্রথমবারের মতো শীর্ষ দশে জায়গা পাওয়া চীন।

গবেষণা শব্দটি নিয়ে এত ভাবার বা গবেষণা করার সময় আমাদের হাতে নেই। কোনো নতুন বিষয় উদঘাটন করতে দরকার সময়, শ্রম ও একাগ্রতা। ধারাবাহিক তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং নতুন কিছু তৈরি করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি বা অন্য কোনো ক্ষেত্রেই আমরা এমন কাউকে পারিনি যে দেশকে উপস্থাপন করতে পারে। ক্লাসে গিয়ে আপনি কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বলুন। দেখবেন ওরা আইনস্টাইন, নিউটন বা স্টিফেন হকিংয়ের নাম বলবে। খুব বেশি হলে দেশের জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম বলবে। সে তো অনেক আগের। এরপর বিশ্বের দরবারে কোনো ক্ষেত্রে আর কতজন অবদান রাখতে পেরেছে যে এই প্রজন্ম তাদের মনে রাখবে? নেই, তেমন কেউ নেই। কারণ আমাদের গবেষক দরকার নাই।

আমাদের দরকার গাড়িতে চড়া বড় বড় চাকুরিজীবি। গবেষণা মূলত একটি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করা এবং সেটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা। সেখানে সময় দিতে হয়, উৎসাহ থাকতে হয় এবং ক্রিয়েটিভিটি থাকা জরুরি। একজন সাহিত্যিক যখন লালন সাঁইকে নিয়ে গবেষণা করেন তখন লালন নিয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি। আবার যদি কোনো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন, তাহলে প্রযুক্তি খাত এগিয়ে যেতে পারে নতুন কোনো আবিষ্কারে। এমনকি পৃথিবীকেও বদলে দিতে পারে। গবেষণার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় সময় এবং অর্থ। এই দুটোই গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে।

এই যে আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, স্বনির্ভর বাংলাদেশের কথা বলি আদতে সেটি অতটা সহজ হবে না। এর প্রধান কারণ আমাদের নিজস্বতা আমরা এখনও তৈরি করতে সক্ষম হইনি। আমরা প্রায় ক্ষেত্রেই আজও বিদেশমুখী। নিজেরা তো তেমন কিছুই করতে পারছি না। নতুন প্রজন্মকে ফেলেছি রাজনীতির ফাঁদে। সেই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তো বাজারে চীনা পণ্যের আধিপাত্য। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তবে যন্ত্রাংশ সেই বিদেশ থেকেই আমদানি করতে হয়। এমন কিছু আমরা করতে পারছি না যা শুধুই নিজেদের। একই ঘটনা অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে। কৃষি ক্ষেত্রে আমরা বেশ কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। তবে অন্য ক্ষেত্রগুলিতে অনেক কম। কারণ সেখানে গবেষণা নেই। সেখানে ধৈর্য ও শ্রম নেই। 

গবেষক হওয়ার ইচ্ছাও নেই। গবেষনা কি এবং কেন দরকার সেই বিষয়টাই অধিকাংশ বুঝতে পারে না। আবার কেউ গবেষণা করতে গেলে যে আর্থিক সাপোর্ট দরকার হয় বা সময় দরকার হয় সেটিও তাকে দেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা এবং গবেষক তৈরি করা উচিত হলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। বরং রাজনীতির গ্যাড়াকলে পরেই অনেকের জীবন  ভিন্ন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। এই ভূমিকায় যারা মানে শিক্ষকেরা পথ দেখানোর কথা তাঁরাও সেটি করছেন না। 

বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কিংবা আগ্রহী হচ্ছে না। এই প্রবণতা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার থেকেও বড় বাধা হলো মানসিকতা। গবেষণার মানসিকতাই প্রথমেই কবর দেওয়া হচ্ছে। তাকে বোঝানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে পড়ার মূল লক্ষ্যই হলো বিসিএসে একটি ভালো ক্যাডারে চাকরি করা। এটা পেলেই জীবনের সব পাওয়া হবে। গবেষণা করে তো এসব কিছুই হবে না। ফলে গবেষণার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার থেকে লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা চাকরির বই পড়াতেই বেশি মনোযোগী থাকে ছাত্রছাত্রীরা। গবেষণা নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের থাকে না। আমরা সবাই ব্যস্ত পাস নিয়ে, সবাই ব্যস্ত চাকরি নিয়ে। তবে গবেষণায় পিছিয়ে থেকে এই শিক্ষা আমাদের ভাগ্যের খুব বেশি উন্নতি করতে পারবে না। 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, পাবনা।

বিকেপি/এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর