আজকের পৃথিবী এক অদ্ভুত সময়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তির চমক চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, তথ্যের স্রোত বইছে অবিরাম, কিন্তু সেই তথ্যের ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে চিন্তার গভীরতা। আগে যেখানে সকালে দরজার নিচে খবরের কাগজ পড়া ছিল প্রতিটি সচেতন নাগরিকের অভ্যাস, এখন সেই জায়গা দখল করেছে স্ক্রিন। আজকের তরুণরা জেগে উঠেই হাতে নেয় মোবাইল, স্ক্রল করে, ক্লিক করে, কিছু পড়ে আবার চলে যায় অন্য লিংকে। তারা খবর জানে, কিন্তু বোঝে না; জানে অনেক, কিন্তু তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে উদাসীন। এই ‘ক্লিকের যুগে’ জ্ঞান হারাচ্ছে গভীরতা, সমাজ হারাচ্ছে বিশ্লেষণক্ষমতা, আর তরুণ প্রজন্ম হারাচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ।
তাই এখন সময় এসেছে আবারও নতুন প্রজন্মকে পত্রিকা পড়ায় ফেরানোর, কারণ পত্রিকা শুধু খবর দেয় না-এটি শেখায় চিন্তা করতে, শেখায় প্রশ্ন করতে, শেখায় মানুষ হয়ে উঠতে। একসময় সকালে পত্রিকার পাতা উল্টানো ছিল একধরনের রীতিনীতির মতো। প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পাতার ছোট বিজ্ঞাপন পর্যন্ত মানুষ পড়ত মনোযোগ দিয়ে। ঘরের টেবিলে সেই খবর নিয়ে আলোচনা হতো, মতের ভিন্নতা থাকত, তর্ক হতো, কিন্তু সেই তর্কের মধ্যেই তৈরি হতো সচেতন সমাজ। পত্রিকা ছিল চিন্তার জ্বালানী, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রতীক। এখন সেই জায়গায় এসেছে দ্রুত ক্লিকের সংস্কৃতি, যেখানে খবর নয়, শিরোনামই শেষ কথা। কয়েকটি শব্দ, কিছু ইমোজি, একটু নাটকীয়তা-ব্যস, হয়ে গেল খবর ভাইরাল। তরুণরা সেই শিরোনাম পড়ে মন্তব্য করে, বিতর্ক করে, আবার পরের ভিডিওতে চলে যায়। কিন্তু সংবাদপত্রের পাঠ মানে ছিল ধৈর্যের শিক্ষা; সেটি শেখাতো তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে, ঘটনা আর প্রোপাগান্ডার পার্থক্য ধরতে। এই শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদ্বেগজনক।
প্রযুক্তি অবশ্যই উন্নতির প্রতীক, কিন্তু প্রতিটি উন্নতির পেছনে লুকিয়ে থাকে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। ক্লিকের যুগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মনোযোগের ক্ষয়। আজকের তরুণদের মনোযোগের স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারা আর দীর্ঘ লেখা পড়ে না, বিশ্লেষণ পড়ে না, সম্পাদকীয় পড়ে না। অথচ একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্ম কতটা চিন্তাশীল, কতটা বিশ্লেষণক্ষম তার ওপর। পত্রিকা সেই বিশ্লেষণের ভিত্তি তৈরি করে। সংবাদপত্রে একটি ঘটনার শুধু উপস্থাপনাই নয়, থাকে তার ব্যাখ্যা, প্রেক্ষাপট, সামাজিক প্রভাব এবং নৈতিক দিকের বিশ্লেষণ। এটি পাঠককে শেখায় কীভাবে ঘটনাকে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, কীভাবে মত গঠন করতে হয়। কিন্তু ক্লিকের যুগে মানুষ শুধু প্রতিক্রিয়া দেয়, প্রশ্ন করে না। আর সমাজ যখন প্রশ্ন করতে ভুলে যায়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়, মানবিকতা নিঃশেষ হয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই মনে করে পত্রিকা পুরোনো মাধ্যম, ধীর এবং একঘেয়ে। তারা চায় দ্রুত কিছু, সরাসরি কিছু, চোখে লাগার মতো কিছু। তাই তারা ঝুঁকে পড়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টিকটক নিউজ ক্লিপ বা ইউটিউব বিশ্লেষকের দিকে। কিন্তু তাদের জানা দরকার-সংবাদপত্রের প্রতিটি শব্দের পেছনে আছে দায়িত্ববোধ, যেখানে মিথ্যা বা গুজবের জায়গা নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু একটি সত্য খবর লিখতে একজন সাংবাদিককে পরিশ্রম করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ক্লিকের যুগের তরুণরা এই পার্থক্য বোঝে না বলেই ভুয়া খবরের ফাঁদে পড়ে, গুজব ছড়ায়, বিভ্রান্ত হয়। পত্রিকা পড়া তাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, কারণ এটি শেখায় যাচাই করা, নির্ভরযোগ্য উৎসে ভরসা করা এবং যুক্তির ওপর আস্থা রাখা।
একটি সমাজে যখন পত্রিকার পাঠ কমে যায়, তখন যুক্তিবাদী চিন্তার জায়গা দখল করে আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া। তখন গুজবই সত্য হয়ে দাঁড়ায়, আর সত্য হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ। পত্রিকার পাঠ একসময় ছিল নাগরিক দায়িত্ববোধের পরিচায়ক; আজ সেটি বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে গণআন্দোলন পর্যন্ত, প্রতিটি সময় সংবাদপত্রই জনগণের কণ্ঠস্বর ছিল। সেই পত্রিকার উত্তরাধিকার যদি নতুন প্রজন্ম না ধরে রাখে, তাহলে ভবিষ্যৎ হবে দিকহীন। কারণ পত্রিকা একটি জাতির স্মৃতি, তার আত্মসমালোচনার আয়না। তরুণদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে সমাজকে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম-এই তিনটি জায়গায় সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। পরিবারে প্রতিদিন অন্তত একটি পত্রিকা রাখার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। অভিভাবক নিজের সন্তানকে প্রতিদিন একটি খবর পড়ে শোনাতে পারেন, আলোচনা করতে পারেন। এতে শিশুর মধ্যে কৌতূহল জন্মাবে, তারা চিন্তা করতে শিখবে। স্কুল-কলেজে “নিউজ আওয়ার” চালু করা যেতে পারে, যেখানে ছাত্ররা প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর আলোচনা করবে, তার সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিউজ ক্লাব’ গঠন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পত্রিকার সম্পাদকীয় বা বিশেষ প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক আয়োজন করবে। এসব ছোট উদ্যোগই ধীরে ধীরে পত্রিকার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারে।
তরুণদের পত্রিকা পড়ার আরেকটি বড় সুফল হলো ভাষাগত উন্নতি। সোশ্যাল মিডিয়ার সংক্ষিপ্ত ও বিকৃত ভাষা ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের লেখার দক্ষতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। পত্রিকার ভাষা শুদ্ধ, স্পষ্ট এবং অর্থবহ। নিয়মিত পত্রিকা পড়লে তরুণরা শুধু তথ্য পায় না, ভাষার সৌন্দর্যও শেখে। তাদের চিন্তা সংগঠিত হয়, লেখার দক্ষতা বাড়ে, যুক্তি পরিষ্কার হয়। একটি সমাজ তখনই অগ্রসর হয়, যখন তার তরুণরা ভাষা ও চিন্তায় সমৃদ্ধ হয়। আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হচ্ছে তথ্যের যুদ্ধ। কে কার ওপর প্রভাব ফেলবে, কে কার মনোযোগ দখল করবে-এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন হেরে যাচ্ছে সত্য।
প্রতিটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার তরুণদের চিন্তার ওপর। যদি তারা শুধু ক্লিক করে, কিন্তু চিন্তা না করে-তবে সমাজ যান্ত্রিক হয়ে যাবে, মানুষ হারাবে মানবিকতা। সংবাদপত্র সেই মানবিকতা ফিরিয়ে আনে। এটি আমাদের শেখায় অন্যের কষ্ট বুঝতে, সমাজের সমস্যায় যুক্ত হতে, এবং দেশের উন্নয়নকে নিজের বিষয় মনে করতে। তাই তরুণদের পত্রিকা পড়ায় উৎসাহ দেওয়া মানে তাদের চিন্তাশক্তি, ভাষাবোধ ও নৈতিক বোধকে শক্তিশালী করা। তথ্যের যুগে সবচেয়ে দুর্লভ জিনিস হলো সত্য। আর সত্যের সন্ধান করতে হলে পড়তে হয়, ভাবতে হয়, সময় দিতে হয়। ক্লিকের যুগে এই সময়টাই সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু একটি জাতি যদি চিন্তার সময় না পায়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পত্রিকা সেই সময়ের মূল্য শেখায়, ধৈর্যের শিক্ষা দেয়, সত্য অনুসন্ধানের প্রেরণা দেয়। তাই এখনই সময় তরুণ প্রজন্মকে এই অভ্যাসে ফিরিয়ে আনার, কারণ পত্রিকার পৃষ্ঠা কেবল খবরের নয়-এটি একটি জাতির বিবেকের প্রতিচ্ছবি।
ক্লিক হয়তো মুহূর্তের আনন্দ দেয়, কিন্তু পত্রিকা দেয় স্থায়ী বোধ। ক্লিক শুধু চোখে লাগে, কিন্তু পত্রিকা মনে গেঁথে যায়। ক্লিক মানুষকে তাড়াহুড়ো শেখায়, পত্রিকা শেখায় থামতে, ভাবতে, বুঝতে। এই বোঝাপড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সভ্যতার ধারাবাহিকতা। তাই ক্লিকের যুগে পত্রিকা পড়া কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা। যদি আমরা তরুণদের এই পথে ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে শুধু সংবাদপত্রই বাঁচবে না-বাঁচবে চিন্তা, যুক্তি, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ। ক্লিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যখন তরুণেরা আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখবে, তখনই শুরু হবে নতুন যুগের সূচনা-যেখানে খবর মানে শিরোনাম নয়, বরং সত্য; তথ্য মানে উত্তেজনা নয়, বরং বিশ্লেষণ; পাঠ মানে সময় নষ্ট নয়, বরং আত্মগঠন। আর এই চেতনা থেকেই গড়ে উঠবে সেই প্রজন্ম, যারা দেশকে দেখবে যুক্তির চোখে, মানবিকতার হৃদয়ে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, রংপুর।
বিকেপি/এমবি

