বলা হয়ে থাকে, একটি দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি অর্জনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র তারুণ্যশক্তি। পৃথিবীর যত মহৎ কর্ম সাধিত হয়েছে, মুক্তির উদ্যম হাওয়া যত প্রান্তর বেয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটির পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে তরুণদের। অথচ আজ সেই তরুণ প্রজন্মের একাংশ যেন ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে অবক্ষয়ের অন্ধকারে। উঠতি বয়সী তরুণদের বড় একটি অংশ এখন মাদকের নেশায়, কিশোর গ্যাং সংস্কৃতিতে, সহিংস বিনোদন ও ভার্চুয়াল আসক্তিতে নিমজ্জিত। তাদের একাংশ বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোয় মত্ত, আবার কেউ সামাজিক শৃঙ্খলা ও নৈতিক মূল্যবোধের সীমা অতিক্রম করছে ভয়ানকভাবে। প্রশ্ন জাগে– এই প্রজন্ম কোথায় যাচ্ছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীই তরুণ (১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী); যারা রাষ্ট্রের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্থাৎ উৎপাদনশীল শক্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই শ্রেণির অনেকেই লক্ষ্যহীন জীবন, হতাশা ও নেশার জালে আটকে পড়ছে। পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে সংঘটিত মোট অপরাধের প্রায় ৪০ শতাংশের সঙ্গে জড়িত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরা। অন্যদিকে, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর তথ্য বলছে, দেশে মাদকাসক্ত রয়েছে প্রায় ৮৩ লাখ, যেখানে গত আট বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশই ছাত্র বা বেকার তরুণ।
তরুণদের বিপথগামীতার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, তরুণদের বিপথগামীতার মূল শেকড় নিহিত রয়েছে পরিবার ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতায়। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম তাঁর অ্যানোমি থিওরিতে বলেন, যখন সমাজে মূল্যবোধের শিথিলতা ঘটে, তখন ব্যক্তির আচরণে নৈতিকতার ঘাটতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোতেও সেই সংকট প্রকট। বাবা-মায়ের ব্যস্ততা, একক পরিবারব্যবস্থা ও ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা সন্তানদের মানসিকভাবে একা করে তুলছে।
মনোবিজ্ঞানী এরিকসনের তত্ত্ব অনুযায়ী, কৈশোরকাল হলো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস-এর সময়; এই পর্যায়ে দিকনির্দেশনা না পেলে তারা সহজেই ভুল পথে যায়। ফলে, পরিবারে ভালোবাসা ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকলে তরুণরা বিদেশী সংস্কৃতির শিকার হয়। তাছাড়া, বন্ধুচক্রের নেতিবাচক প্রভাব ও সামাজিক প্রতিযোগিতা থেকে জন্ম নেওয়া মানসিক চাপ তাদের বিকল্প বাস্তবতায় নিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, সমাজে অর্থ ও বিলাসিতাকে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে দেখানোর প্রবণতাও তরুণদের দিকভ্রান্ত করছে।
ডিজিটাল যুগ তরুণদের জন্য যেমন নতুন কর্মসংস্থানসহ স্বস্তির দুয়ার খুলে দিয়েছে, তেমনি এটি এক ভয়াবহ ভার্চুয়াল আসক্তিও তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টিকটক, ইউটিউব বা অনলাইন গেম এখন অনেক তরুণের মানসিক জগতের নিয়ন্ত্রক। তাছাড়া অনেক কিশোর বা তরুণ বাস্তব জীবনে ভার্চুয়াল হিরোদের অনুকরণ করতে গিয়ে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও মানবিকতা হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোরদের মধ্যে হিরোইজম ভাব বেশি কাজ করে। যখন তারা দেখে যারা অপরাধ করছে, তারা সমাজে বেশ লাভবান তখন কিশোর কিংবা তরণরা সেটিই অনুসরণ করে থাকে। তাছাড়া, আমাদের সমাজে নানা অসঙ্গতিও রয়েছে বটে। দেশীয় সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে বিদেশি সংস্কৃতিকে ধারণ করে কিশোররা নিজেদের জীবনে তার চর্চা করছে।
তরুণ সমাজের এই অবক্ষয়ের ছাপ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও এড়ানো যায় না। একসময় যে সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ছোট-বড়দের পারস্পরিক সম্মান এবং সামাজিক ঐক্য ছিল দৃঢ়; আজ সেখানে দেখা দিয়েছে বিচ্ছিন্নতা ও ভাঙ্গনের সুর। ফলত নৈতিকতার জায়গাটুকু কেন্দ্রীভূত হয়েছে আত্মপ্রচার ও দাম্ভিকতার সংস্কৃতিতে। এই পরিবর্তন শুধু সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেই নয় বরং অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যতকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থারও দায় এড়ানো যায় না। নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনের চর্চা শিক্ষাব্যবস্থায় ধীরে ধীরে ক্ষয় এসেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিকতার পরিবর্তে প্রাইভেট, পরীক্ষা, ও ফলাফল নির্ভর চাপ তৈরি হচ্ছে। ফলে কিশোর কিংবা তরুণরা কেন পড়ছে– এই প্রশ্নের উত্তর হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষা যদি নৈতিকতাকে পাশ কাটিয়ে শুধু প্রত্যাশিত ফলাফল ও চাকরি পাওয়ার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তবে সুনাগরিক তৈরি পথ কুন্ঠিত হয়ে যায়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানবিকতা, নৈতিকতা ও বাস্তব দক্ষতার সমন্বয়ে নতুনভাবে সাজানো জরুরি।
তরুণদের এই অবস্থার জন্য শুধু পরিবার বা শিক্ষা নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোও সমানভাবে দায়ী। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি, এবং তরুণবান্ধব কর্মসংস্থানের অভাব তাদের হতাশ করে। তাছাড়া, রাজনীতিতে তরুণদের ব্যবহার করা হয় অনেকাংশে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে, যেখানে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব তৈরির পরিবেশ রূদ্ধ রাখা হয়। মিডিয়াও অনেক সময় নেতিবাচক কনটেন্ট প্রচার করে তরুণদের অনুপ্রেরণা নয়, বরং বিভ্রান্ত করে তোলে।
তবে সব তরুণ বিপথে নয়। অনেকেই এখনো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছে। কেউ উদ্যোক্তা হচ্ছে, কেউ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যুক্ত, কেউ পরিবেশ রক্ষা বা সামাজিক সেবায় কাজ করছে। তাদের উদ্যোগ প্রমাণ করে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুকূল পরিবেশ পেলে তরুণরা আবারও জাতির গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে। যেমন, দেশে আজ তরুণ উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে শত শত স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে; যা অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
তরুণদের পুনরায় সঠিক পথে আনতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া আপনারই দায়িত্ব। তার দেখভাল আপনাকেই করতে হবে। সন্তানের বন্ধুমহল তৈরিতেও সতর্ক থাকতে হবে। সর্বপরি, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষাই পারে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের সুপথে পরিচালিত করতে। তাছাড়া, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার বহুল পাঠ। শিশু-কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য প্রতিটি জেলায় রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারও গড়ে তুলতে হবে। কিশোরদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশু পরিচর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। তাদের সৃজনশীল ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, আত্মমর্যাদা ও মানবিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে; যাতে তারা সমাজ গঠনের অংশীদার হয়, ধ্বংসের নয়।
তারুণ্য জাতির প্রাণশক্তি, পরিবর্তনের প্রতীক। সঠিক দিকনির্দেশনা ও মানবিক শিক্ষা পেলে এই শক্তিই হতে পারে নতুন বাংলাদেশের পুনর্জাগরণের অগ্রদূত। কিন্তু যদি তা অবক্ষয়ের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, তবে সেটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ বিপদ। তাই এখনই সময় তরুণদের পুনরায় নৈতিক, মানবিক ও সৃষ্টিশীল জীবনের পথে ফিরিয়ে আনার।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিকেপি/এমবি

