Logo

মতামত

মানবিক সমাজ গঠনে সুশাসনের ভূমিকা

Icon

মূহাম্মদ নূরুল আলম

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬

মানবিক সমাজ গঠনে সুশাসনের ভূমিকা

বর্তমান সমাজে প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন বিস্ময়কর, তেমনি নৈতিকতার অবক্ষয়ও ভয়াবহ হারে বাড়ছে। দুর্নীতি, মাদক, সহিংসতা, অমানবিকতা-এসব সামাজিক ব্যাধি আজ আমাদের চিন্তায়, আচরণে, এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনাতেও প্রভাব ফেলছে। এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ হতে পারে তিনটি উপাদান-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন। এই তিনের সমন্বয়েই সম্ভব একটি সুশৃঙ্খল, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। 

নৈতিকতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা ও কাজের শুদ্ধতার মাপকাঠি। এটি মানুষকে সঠিক-ভুল পার্থক্য করতে শেখায় এবং দায়িত্বশীল আচরণে উৎসাহিত করে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংগঠন-এসব জায়গা থেকেই নৈতিকতার পাঠ শুরু হওয়া উচিত। আজকের সমাজে নৈতিকতার অভাব প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে সত্যকে বিকৃত করছে, দায়িত্বকে এড়িয়ে যাচ্ছে, আর অনৈতিক উপায়ে সফলতাকে গৌরবের বিষয় মনে করছে। ফলে মানুষ মানুষের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে, সমাজে বাড়ছে হিংসা, প্রতারণা ও অবিশ্বাস। নৈতিকতার পুনর্জাগরণের জন্য দরকার পরিবারভিত্তিক চরিত্রগঠন, বিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষার কার্যকর প্রয়োগ এবং সমাজে ন্যায়ের চর্চা। নৈতিক মানুষই পারে ন্যায় ও নীতির ভিত্তিতে সমাজকে আলোকিত করতে।

মূল্যবোধ সমাজের প্রাণশক্তি। মূল্যবোধ হলো সেই অভ্যন্তরীণ নীতি, যা মানুষকে মানবিক ও দায়িত্বশীল করে তোলে। সহমর্মিতা, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা-এসবই একসময় ছিল আমাদের সামাজিক জীবনের ভিত্তি। কিন্তু আধুনিক যুগের ভোগবাদ, প্রতিযোগিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা এই মূল্যবোধগুলোকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করছে। এর ফলেই আমরা পরিবারে অবিশ্বাস, কর্মক্ষেত্রে অনিয়ম, রাজনীতিতে অপসংস্কৃতি ও সমাজে সহিংসতার চিত্র দেখতে পাই। মূল্যবোধ হারালে নৈতিকতা টেকে না, আর নৈতিকতা হারালে সমাজ ভেঙে পড়ে। এই বাস্তবতা থেকে মুক্তির পথ হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মূল্যবোধকে পুনঃস্থাপন করা। শিক্ষার্থীদের কেবল জ্ঞান নয়, সঠিক আচরণের শিক্ষা দিতে হবে। সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইতিবাচক ও মানবিক বার্তা ছড়াতে হবে।

সুশাসন ন্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। সুশাসন মানে কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। যখন প্রশাসন বা রাজনীতি থেকে নৈতিকতা হারিয়ে যায়, তখন ক্ষমতা হয়ে ওঠে স্বার্থের হাতিয়ার। এই অবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম, পক্ষপাত ও বৈষম্য সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। সুশাসন সেই অব্যবস্থার প্রতিষেধক। সুশাসনের জন্য দরকার- ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা, স্বচ্ছ প্রশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, জনগণের অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা। রাষ্ট্রযন্ত্রে নৈতিকতা বজায় রাখতে হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হতে হবে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। জনগণকেও প্রশাসনের জবাবদিহিতা দাবি করতে হবে। কারণ, সুশাসন তখনই সফল হয়, যখন নাগরিকরাও সচেতন ও দায়িত্বশীল হন।

নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসনের পারস্পরিক সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। নৈতিকতা মানুষকে সৎ করে, মূল্যবোধ তাকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে, আর সুশাসন সেই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ঘটায়। যদি নৈতিকতা না থাকে, সুশাসন টেকসই হয় না। আর সুশাসন না থাকলে নৈতিক ও মূল্যবোধনির্ভর সমাজ গড়ে তোলা যায় না। তাই ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও রাষ্ট্রীয় সুশাসনকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে হবে।

সমাজের অবক্ষয় রোধে বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষা ও নাগরিক দায়িত্ববোধের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অভিভাবকরা সন্তানদের সামনে সততা, নম্রতা ও দায়িত্বের উদাহরণ স্থাপন করবেন। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিবিরোধী নীতি বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে। গণমাধ্যম যেন কেবল সংবাদ নয়, সামাজিক মূল্যবোধ প্রচারের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। সুশাসনে জনগণের মতামত, তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে প্রশাসন হবে জনবান্ধব। নেতৃত্বে সততা ও দায়বদ্ধতার অভাবই সমাজে অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। সৎ নেতৃত্বই সমাজে আস্থার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। 

সমাজের অবক্ষয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি দীর্ঘদিনের নৈতিক দুর্বলতা ও সুশাসনের ঘাটতির ফল। এর প্রতিষেধকও দীর্ঘমেয়াদি- নৈতিকতার চর্চা, মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ এবং সুশাসনের প্রতিষ্ঠা। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন নাগরিক, যারা নীতিতে দৃঢ়, মূল্যবোধে সমৃদ্ধ এবং দায়িত্ববোধে সচেতন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা যদি এই নৈতিক চেতনার সঙ্গে একীভূত হয়, তবে সমাজ থেকে অবক্ষয়ের অন্ধকার দূর হবে। আমরা যদি আজ থেকেই নিজেদের জীবনে নৈতিকতার চর্চা শুরু করি, মূল্যবোধকে ধারণ করি, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখি-তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যেতে পারব এক মানবিক, আলোকিত ও ন্যায়নিষ্ঠ বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিশ্লেষক
পরিচালক, বিসিএস অদিতি ক্যারিয়ার

বিকেপি/এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর