Logo

মতামত

দেশের অধিকাংশ নেতা নিজের চেহারা আয়নায় দেখেন না

Icon

মো. সোয়েব মেজবাহউদ্দিন

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১৫

দেশের অধিকাংশ নেতা নিজের চেহারা আয়নায় দেখেন না

রাজনীতির নামে বাংলাদেশে নাটক চলছে। আমারা চাই নীতিবান, চরিত্রবান ও আদর্শবান নেতা। যিনি নিজের পকেটের টাকা দেশ ও দশের কাজে খরচ করবেন। দুঃখজনক হলেও সত্যবর্তমান সময়ে সেই ধরনের নেতার বরই অভাব। বর্তমানে নেতা মানে, চাঁদাবাজ, নেতা মানে দূর্নীতিবাজ ও চরিত্রহীন একজন লোক।

৬০-৬৫ বছর হলে শারিরীক ও মানষিকভাবে অক্ষম হিসাবে ধারনা করে চাকুরী করার অযোগ্য বিবেচনা করে যেমন চাকুরী থেকে অবসর দেওয়া হয়। ঠিক তেমনী সেই ৬৫ বছর বয়সের লোকাটিকে এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার অযোগ্য ঘোষনা করা উচিত। কারন একটি দেশে পরিচালনা করতে হলে শারিরীকভাবে ও মানষিকভাবে সুস্থ থাকাটা খুবই জরুরী। এসব অযোগ্য লোক যতই অভিজ্ঞ হোক তার কাছ থেকে আর যাই হোক আধুনিক কোন পরিকল্পনা আসা করা যাবে না। তারা মান্ধাতার আমলের চিন্তাধারা নিয়ে দেশ ও দশের জন্য কিছুই করতে পারবে না। অথচ আমাদের দেশে কোন নেতা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছে এমন কোন নজির নেই। মৃত্যর পূর্ব পর্যন্ত তারা দলের দেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।

আমরা কাকে ‘ভালে নেতা’ বলব? আজ পুরো রাজনীতি নোংরায় জর্জরিত। ভালো ও চরিত্রবান নেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাবেই কি করে, নেতা হতে হলো কোন না কোন দলে নাম লেখাতে হবে। দলে অন্তরভুক্ত হওয়ার পর দলকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হবে। দলের কর্মীদের টাকা দিয়ে পালতে হবে। কর্মীদের অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দিতে হবে। কর্মীদের নিজের পকেট থেকে টাকা না দিতে পারলে বিভিন্ন স্থান থেকে চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, দখলবাজীর মত নোংরা কাজে লাগাতে হবে।

মঞ্চে উঠে নেতারা বড় বড় আদর্শ শুনাবে। কর্মীরা শ্লোগান দিবে, “আমার নেতার চরিত্র ফুলের মত চরিত্র।”কর্মীরা কালারফুল বড় বড় ব্যানার, পোষ্টার তৈরী করে নেতার ছবির পাশে তার ছবি দিয়ে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, বাস স্টান্ডে, লঞ্চ ঘাটে টানিয়ে রাখবে। কর্মীরা যখন বিভিণ্ন উপলক্ষে বিভিন্ন দোকানে চাঁদা তুলতে যাবে তখন যাহাতে পোষ্টারে থাকা ছবি দেখে চাঁদা প্রদানকারী বুঝতে পারে এই চাঁদাবাজ ওমুক নেতার কর্মী।  একসময় দেখেছি নেতারা নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে এলাকার অসহায় মানুষকে সাহায্য করতো। এখনকার নেতারা প্রতিপক্ষেরনেতাকে শেল্টার দেওয়ার নামে চাঁদা নিচ্ছে। কমিপয় নেতার বক্তব্য এখন মেম্বার, চেয়ারম্যান হতে দলীয় মনোনয়নের প্রয়োজন হয়। সেই দলীয় মনোনয়ন পেতে লক্ষ লক্ষ টাকা লাগে।

নির্বাচন করতে টাকা লাগে। আগে রাজনৈতিক নেতাগিরী চিল সেবা, এখন রাজনৈতিক নেতাগিরী মানে ব্যবসা। এখনকার রাজনীতির নৈতিকতা এখন প্রেস রিলিজে ও মিথ্যা বক্তব্যে বন্দি, সৎ নেতৃত্ব কেবল পোস্টারে। দেশের রাজনীতি যেন এক মঞ্চ, যেখানে ভালো হওয়ার মানে নেতার সত্য মিথ্যা সব কথাকে হ্যাঁ বলা। আর সত্য কথা বললেই আপনি খারাপ। বাংলাদেশ রাজনীতি একটা নির্দিষ্ট অদৃশ্য লোহার শিকলে বন্দি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পাশ করে কেই আর রাজনীতি করেনা।  সরকারী বা বেসরকারী চাকুরী হয়ে অবসর হয়ে যে লোকটির ধর্ম কর্ম করে জীবনের বাকিটা সময় পরিবার পরিজন দিয়ে হাসিখুশীভাবে জীবন নির্বাহ করার কথা, সেই লোকটি এখন এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য তার নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েতার সন্তানতুল্য নেতাকে সালাম দিচ্ছে, তার পেছনে শ্লোগান দিচ্ছে, তাকে আদর্শবান নেতা বানিয়ে তার ছবির সাথে নিজের ছবি দিয়ে পোষ্টার বানিয়ে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে টানিয়ে দিচ্ছে। একটুও লজ্জা হয় না।  

আজকের ডিজিটাল যুগে সকল শ্রেনীর লোকের কাছে স্মাট মোবাইল ফোন, যে কোন প্রকার সংবাদ মোবাইলে ইন্টাননেটের মাধ্যমে খুব সহজে জানা যায়, কোন নেতার চরিত্র কি। কোন নেতা কি করে জীবন নির্বাহ করে। আমাদের দেশে কোন নেতা মাদক সম্রাট, কোন নেতা বালুখোর, কোন নেতা চাঁদাবাজ সবাই জানে। সাধারন নিরীহ জনগন আজ রাজনৈতিক নেতাদের সমানে সালাম দেয়, আর পেছনে ঘৃনা করে। নেতাদের সন্তানদের সাথে আর কেই তর আতœীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়না। এখনকার সময়ে নেতা মানে মিথ্যাবাদী, ভন্ড, প্রতারক ও চরিত্রহীন। আদর্শবান সত্যবাদী নেতার বরই অভাব। 

একটি দেশের ভিত্তি কখনোই কোনো বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল হতে পারে না। দেশে বা রাষ্ট্র টিকে থাকে নীতি, আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধে। ভালো হতে হবে নেতাদের নীতি। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শারিরীক ও মানষিকভাবে সুস্থ্য লোকদের। কোন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন নাই। যে কোন সাধারন লোক দেশের খেদমত করার ইচ্ছা হলেই মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি নির্বীচন করতে পারবে। টাকা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার নীতি বাতিল করতে হবে। তাহলেই দেশে নেতাদের মধ্যে মারামারি, হানাহানি বন্ধ হবে। কিন্তু আমরা এমন এক স্বপ্নের স্রোতে ভেসে চলেছি যেখানে দেশ মানে একটি দল এবং দল মানে দেশ। কোন একটি দল ক্ষমতায় যাওয়া মানেই সেই দল ও দলের নেতারা অপরাধের দায়মুক্তি, ক্ষমতাশীন দল ন্যায় অন্যায় সব করতে পারবে। প্রশাসন তাতে কোন প্রকার বাঁধা দিবে না। আর বিরোধী দলে থাকা মানেই রাজনৈতিক অপরাধী। বিরোধী দল কোন মিছিল মিটিং করলেই পুলিশের ধাওয়া খেতে হবে। পুলিশের মার খেত হবে। এই সংকীর্ণ মানসিকতাই আমাদের গণতন্ত্রকে করেছে দলবাজির খেলাঘর।  আমাদের সবচেয়ে বড় অভাব আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্বের। আমাদের দেশে এমন নেতা দরকার, যিনি নিজের বিবেককে শাসকের থেকেও বড় ভাবেন। যিনি দলের নির্দেশ নয়, দেশের ও দশের কল্যাণকে কাজ করবেন।  

দেশের প্রতিটি দল থেকে সৎ, জ্ঞানী, নীতিনিষ্ঠ মানুষদের আলাদা করে সমাজের সামনে তুলে ধরতে না পারি, তবেই দেশের ভাগ্য বদলাবে না। নেতৃত্বের বদলে শুধু পোশাক বদল হবে। আমাদের জনগণ শুধু দর্শক হয়ে দেখছে কতিপয় দলের মারামারি, হানাহানি, রক্তারক্তি।  আমরা আজ এমন এক মানসিক কাঠামোতে বাস করছি, যেখানে আমিই একমাত্র ‘ভালো মানুষ’, আমার রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ভাল মানুষ। এই মানসিকতা শুধু সংকীর্ণ নয়, আত্মবিনাশীও। যখন নীতির বদলে দলীয় পরিচয় দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার হয়, তখন আসলে মরে যায় বিবেক, সমাজ হারায় নিরপেক্ষ চিন্তার স্পন্দন। একজন সমাজকর্মী, একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, একজন সাহসী সাংবাদিক যদি আপনার দলবিরোধী মতামত পোষণ করেন, তাহলে কি তার সব গুণ অচল হয়ে যাবে? এটিই হচ্ছে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সবচেয়ে গভীর চিহ্ন।  

আজকাল আমরা এমন এক রাজনীতির রীতি গড়ে তুলেছি, যেখানে ‘দেশসেবা’ কথাটি নিছক মিথ্যাচার। মিটিংয়ে বড় বড় কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে পদের লোভ, প্রজেক্ট, কমিশন বানিজ্য, বিদেশ সফরের আয়োজন। দেশকে সামনে রেখে নিজের নামে মঞ্চে সমাপ্তি এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা। এরা বলে, ‘জনগণের পাশে আছি’, কিন্তু  টাকার বিনিময়ে জনগনের কাজ করে নিজের আখের গোছায়, নিজের নিরাপত্তা, নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য। তারা বলে, ‘সাধারণ মানুষের কথা বলি’, অথচ সেই সাধারণ মানুষের খাজনা, ঘুষ ও দুর্ভোগে নিজেদের প্রাসাদ গড়ে তোলে। যারা নিজের বিলাসী জীবনকে দেশের ওপরে রাখে, তারা কোনোভাবেই ভালো মানুষ হতে পারে না। সত্যিকারের ভালো মানুষ সে-ই, যে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ায় শুধু প্রচারের জন্য নয়, অন্তর থেকে দেশের মানুষকে ভালভাসে।

এ দেশের অধিকাংশ নেতা নিজের চেহারা আয়নায় দেখেনা। আত্মসমালোচন করে না। তার নিজেকে আয়নার সামনে সবচেয়ে বেশি দরকার, নেতারউচিত তার নিজের ভুল দেখা, নিজের দোষ খোঁজা, নিজের আচরণ পুনর্মূল্যায়ন করা, নিজের বিবেককে জাগ্রত করা, আজ তাদের অনেকেরই নেই। তারা ভুল করলেও তা স্বীকার করেন না, বরং জনগণ না বুঝুক সেটাই যেন তাদের জন্য আশীর্বাদ। তারা ভাবেন,  জনগন বোকা, তারা চালাক। যেসব নেতা নিজের বিবেককে প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফেলবেন, সেদিন নেতৃত্ব হয়ে ওঠে অহংকারের প্রতিমূর্তি। আত্মসমালোচনা আসলে দুর্বলতা নয় এটি মহত্তের সূচনা। একজন সত্যিকার নেতা তার ভুলেন দায় নেয়, সংশোধন করে এবং নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়। আত্মসমালোচনাহীন নেতৃত্ব মানেই জবাবদিহি বিহীন শাসন, যা কোনো সমাজের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না। 

লেখক :  মিডিয়া কর্মী

বিকেপি/এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর