Logo

মতামত

রাজনীতি নতুন প্রজন্মের, না পুরোনো বন্দোবস্তের?

Icon

জায়েদ আনসারী

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:০৮

রাজনীতি নতুন প্রজন্মের, না পুরোনো বন্দোবস্তের?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বহুমুখী দ্বান্দ্বিক অবস্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক এলিট ও প্রজন্মের চাওয়া পরস্পর বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। মেরুকরণ করারও চেষ্টার কমতি নেই। রাজনৈতিক বোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেওয়া গোষ্ঠী ও দল প্রজন্মের চাওয়াকে পাশ কাটিয়ে পুরোনোকে ধারণ করে এগোতে চায়। রাজনীতিতে যে এলিটভাব দীর্ঘ সময়ে তৈরি হয়েছে তার কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেকোনো মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছেন না রাজনৈতিক এলিট পরিচয় দেওয়া নেতারা। কার্যত, সময়ের সাথে তা ফিকে হয়ে সামনে আসবে বলে মনে হচ্ছে।

‘জেন জি’ প্রজন্ম রাজনৈতিক কুৎসিত এলিটদের সিন্ডিকেট ভাঙতে চায়। যার কারণে চব্বিশের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। সেই কুৎসিত ব্যবস্থায় সামনে পথ চলতে চায় না তারা। নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদের আগামীর পথ নির্মাণ করতে চায়। এজন্য নানা সমীকরণ ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের পা বাড়াতে হচ্ছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর। তবে জেন জি প্রজন্মকে এই যাত্রায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর তা না হলে তাদের গন্তব্য হয়ে উঠবে অনিশ্চিত। ভেস্তে যাবে নতুন বাংলাদেশের সোনালী স্বপ্ন।

ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে রাজনীতির মেরুকরণ শুরু হয়েছে। বিদেশি কয়েকটি পক্ষ এখানে নানাভাবে এসবের কলকাঠি নাড়ছেন— এমন কথাও প্রচলিত। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো তাদের প্রকাশ্য নানা এজেন্ডা সামনে নিয়ে এসে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্পষ্ট ধারণা দেবে— এমন প্রত্যাশা সকলের। বেশ কিছুদিন ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ড সমালোচনায়। খোদ বিএনপি এই কমিশনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অথচ দলটি এই কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেদের মতামত দিয়েছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মতো যুক্তি ও পরামর্শ তুলে ধরেছে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তবে কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকায় এনসিপি সহ কয়েকটি দল জুলাই সনদে সই করেনি। তবে তারা বলেছে, তাদের দাবি— অর্থাৎ নির্বাহী ঘোষণার মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিলে তারা সনদে সই করবে। অন্যদিকে জামায়াতসহ আটটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে সেই আলোকে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটেরও দাবি করে আসছে।

সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণভোটের দাবির বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চরম বিরোধীতাপূর্ণ বক্তব্য জোড়ালোভাবে সামনে আসছে। যার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করার নামান্তর ঘটছে। সমালোচনার অবশ্যই সুযোগ আছে। তবে সেটিরও একটি সীমা থাকে। রোববার (৯ নভেম্বর) এক বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘শিক্ষিত কিছু ওপরতলার লোক, যারা আমেরিকা থেকে এসে এসব (সংস্কার) আমাদের ঘাড়ের ওপর চাপাচ্ছেন। আমরাও মেনে নিয়েছি। তারা যতগুলো সংস্কার করতে চান, তাতে আমরা রাজি আছি। যেটাতে রাজি হব, সেটা বাস্তবায়িত হবে। যেটাতে রাজি হব না, সেটা পার্লামেন্টে যাবে। সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, এরপর তা পাস হবে।’

তার এমন বক্তব্যের পাল্টা অন্য দলগুলো বললে অবস্থা কী দাঁড়াবে ঐকমত্য কমিশনের? মূলত কমিশনকে ব্যর্থ করার জন্য এসব বক্তব্য কি, তা হয়তো ‘জেন জি’ ও সাধারণ নাগরিকরা বুঝতে ভুল করবে না। যেহেতু উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কমিশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে— যা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অভিযোগটি হলো, তিনি (ফখরুল) বলেছেন, ‘গণভোট কী? জুলাই সনদ কী? এসব জনগণ বোঝে না।’ জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞান নিয়ে তার এমন বক্তব্য কতটুকু জাতি গ্রহণ করবে— সেই প্রশ্নও থেকে যায়। কারণ, তার ভাষায় যে জনগণ এসব (গণভোট ও জুলাই সনদ) বোঝে না, তা নিয়ে কেন বিএনপি সময় দিল, সই করল এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করার সুযোগ দিলো? দায় এড়ানোর সুযোগ আসলে থাকে না। অথবা দলীয় স্বার্থে পুরানো বন্দোবস্তে জনগণকে চালানোর পথ নির্মাণের চেষ্টা এটি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে অবশ্যই বোদ্ধা রাজনীতিকরা রয়েছেন। তাদের পক্ষ থেকে যখন বলা হয়, পিআর বুঝি না, এই সংবিধানে গণভোটের সুযোগ নেই— তা হাস্যকর। কারণ, তাদের প্রস্তাব মতে নির্বাচনের দিন গণভোট করা যাবে। প্রশ্ন হলো জাতীয় নির্বাচন তখন কোন সংবিধানের আলোকে হচ্ছে? নির্বাচন যেহেতু বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে হচ্ছে, সেহেতু তারা জনগণকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

পুরানো বন্দোবস্তে বাংলাদেশের আগামীর রাজনৈতিক যাত্রা যে শুভ হবে না, তার নমুনা আমরা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছি। চব্বিশের বিপ্লবের পর দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল দাবি করা বিএনপি মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে বেশ বিপাকে রয়েছে। কৌশলগত কারণে তাদের ভাষায় বেশ কিছু আসনে তারা মনোনয়ন দেয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে আবার গাইবান্ধা ও কুমিল্লায় বিক্ষোভ ও নিজেদের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। বাধ্য হয়ে গাইবান্ধায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এসব মূলত পুরানো বন্দোবস্তের ফল। এখনো অনেক সময় বাকী, তাতেই এমন হলে পদচ্যুত ফ্যাসিবাদ ও দুর্বৃত্তায়ন শুরু করলে অবস্থা কী হতে পারে— তা হয়তো রাজনীতি সচেতনরা অনুমান করতে পারছেন।

আগামী নির্বাচনকে ঘিরে মাঠের রাজনীতি উত্তপ্ত হবে না, সৌহার্দ্যমূলক হবে— সেই পথরেখা এখনই নির্ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক সৌহার্দ্য নির্বাচনে না থাকলে বিপ্লবের কোনো মানে থাকবে না। প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না তুলতে পারলে সংস্কার ব্যর্থ হবে। জুলাই সনদ বলি আর জুলাই ঘোষণা বলি— কোনোটিই অর্থ বহন করবে না। পুরানো বন্দোবস্তে জাতি আবারও প্রতারণায় জালে আটকে থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জুলাই অভ্যুত্থান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর