শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং নাগরিকের নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিকাশ সাধনই হল রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে সরকারের মাধ্যমে। রাষ্ট্র ও সমাজভেদে এ সরকার ব্যবস্থা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কোন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকলে অন্য কোন রাষ্ট্রে হয়তো একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্র দেখা যায়। আবার শাসন ব্যবস্থায় প্রধান কর্তৃত্ব কার হাতে ন্যস্ত থাকবে তার উপরও সরকারের ধরণ নির্ভর করে। তবে জনগণের সর্বাধিক অংশগ্রহণে গঠিত সরকারই স্থায়ী ও সফল হয়ে থাকে। আর সেই সরকার পরিচালিত হয় জনগণের করের অর্থে।
জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বাস্তবায়নের জন্যই মূলত রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক কাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের সূচনা। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো যদি জনগণের সেবকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ না হয়ে লুটেরাদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়, তখন রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে, জনগণের মধ্যেও এক ধরণের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো যেন সেই ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত দীর্ঘদিন ধরেই; যেখানে দুর্নীতি এক মহাযজ্ঞে রূপ নিয়েছে; যার পুরোহিত রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ঠিকাদার থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন নেটওয়ার্কের এক অদৃশ্য হাত।
সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৩টি জলবায়ু তহবিলভুক্ত প্রকল্পে ২,২১০ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিল থেকে বরাদ্দ পাওয়া অর্থের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিপূর্ণ উপায়ে ব্যয় হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
টিআইবি’র তথ্যমতে, প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৮৯টি প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম, ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই টাকাগুলো বরাদ্দ করা হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায়, কিন্তু সেগুলোর একটি বড় অংশ গেছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী, আমলা এবং ঠিকাদার সিন্ডিকেটের পকেটে। এই প্রেক্ষাপটে টিআইবি-এর তথ্য বলছে যে, ২০২৪ সালের দুর্নীতি ধারণ সূচকে বাংলাদেশ মাত্র ২৩ (১০০ বিন্দু স্কেলে) পেয়েছে, যা ২০২৩ সালের স্কোর (২৪) থেকে এক পয়েন্ট কম। এবং দেশের অবস্থান হয়েছে ১৫১তম (১৮০ দেশের মধ্যে) – যা গত ১৩ বছরে সর্বনি¤œ। টিআইবি-এর মতে, এই অবনতির কারণ হলো ক্লেপ্টোক্র্যাটিক ও অটোরিটেরিয়ান অর্থ্যাৎ লুটতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন; যা দুর্নীতিকে শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, বরং সেটিকে উৎসাহিত করেছে।
তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর ২,৫০,০০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ হয়। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ানোর অনুমোদন এখন দুর্নীতির বৈধ মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক প্রকল্পে ২০১৮ সালে ব্যয় বেড়েছিল প্রায় ৩২%, আর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ৫১%। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বড় অংশই কমিশন, ঘুষ ও অনিয়মের ফাঁদে হারিয়ে যায়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, দুর্নীতি বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৫% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
এই অবস্থায়, দুর্নীতি ধারণ সূচকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সরকারি ক্রয় ও প্রকল্প বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশেষত জলবায়ু প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে এ অবস্থা বেশ দৃশ্যমান। ফলত এসব খাতে প্রকল্প হয় বিলম্বিত, গড়ে ওঠে মানহীন অবকাঠামো এবং জনগণের অর্থ ঝুঁকির মুখে পড়ে। অথচ এই লুটেরাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয় নামমাত্র, বিচার হয় না বললেই চলে।
দুর্নীতি টিকে থাকে আরেকটি বড় কারণ দুর্নীতি করেও সমাজে নিরাপদ থাকার প্রবণতা। দেশে প্রায় প্রতিটি আলোচিত দুর্নীতির মামলা হয় ধীরগতি, না হয় রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে সেটি সমাধান হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দেখানো হয়; আর আমলাদের ক্ষেত্রে তা হয়ে যায় একধরণের প্রশাসনিক প্রতিরক্ষা। ফলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা, যেমন– দুদক কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সর্বস্তরে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় বরং লুটোরদের হাতে জিম্মি থাকে, তাহলে উন্নয়নের সূচক যতই বাড়–ক, তা কেবল-ই বাহ্যিক চাকচিক্যে সংখ্যার খেলা হয়ে থাকবে। তবে দুর্নীতি দমন কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি নৈতিক যুদ্ধ। প্রশাসনের প্রতিটি পদে যদি নৈতিক দায়বদ্ধতা তৈরি না হয়, তবে কোনো প্রযুক্তি বা আইন দুর্নীতি রোধ করতে পারবে না। রাষ্ট্রকাঠামোতে লুটেরাদের যে স্বর্গরাজ্য গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে দিতে না পারলে, দুর্নীতির মহাযজ্ঞ আরও ভয়ংকর রূপ নেবে, যার পরিণতি হবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সংকট।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিকেপি/এমবি

