শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর একটি আদর্শ, নৈতিক জ্ঞান ও মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গড়ার কারিগর হলেন একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের আলোর পথের সন্ধান দেন শিক্ষকরা। তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে তোলেন। জাতির অগ্রগতির পিছনে শিক্ষকদের অবদানই সিংহভাগ। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘যদি তুমি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাকো; তাহলে মনে রাখবে তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিলো যে তোমাকে সাহায্য করেছিলো।’ এভাবে পৃথিবীর স্মরণীয়, বরণীয় মানুষগুলো শিক্ষকদের সম্মান দিয়ে গেছেন। কারণ একজন শিক্ষক তার ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, কর্ম দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আগামীর স্বপ্ন হিসেবে গড়ে তোলেন। এজন্য শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন হওয়া দরকার।
শিক্ষকরা যদি অবহেলিত বা বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক একটি প্রভাব পড়বে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষায় ঘাটতি দেখা দিবে। শিক্ষকরা পাঠদানে ঠিকমতো মনোযোগী হতে না পারলে; শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটবে। আমরা দেখেছি, আমাদের সমাজে শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা অনেক বেশি। সবাই শিক্ষকদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। কিন্তু দেখা গেছে, শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা হলেও এখানে আর্থিক নিরাপত্তা অনেকটা কম। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনান্য পেশাজীবীদের সাথে তাদের বেতন ভাতা বা সুযোগ সুবিধা তুলনামূলক আরও বাড়ানো দরকার। তারা যেন তাদের দাবি নিয়ে স্কুল, কলেজ বন্ধ করে বার বার রাস্তায় না নামে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কিন্তু দেখা গেছে, বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আমাদের শিক্ষকরা যখন বারবার রাস্তায় নামেন; তখন কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। স্কুলে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষকরা রাস্তায় এসে আন্দোলন করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষকরা তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে এসে কিংবা বৈধ দাবিদাওয়া তুলে ধরতে এসে কিছু কিছু সময় অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে তুলছেন। অনেক সময় তারা গণমাধ্যমকে আকর্ষণ করতে মিথ্যা কথার আশ্রয় নিচ্ছেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন নিম্নমানের বক্তব্য কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সবশেষ রাজধানীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড দেওয়া; ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড দেওয়া সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির নিশ্চয়তায় তারা আন্দোলনে এসেছেন। সেখানে দেখা গেছে, একজন নারী শিক্ষক গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন ‘২০ বছর আগে একটি ফার্মের মুরগি কিনেছিলেন বাচ্চাকে খাওয়াবেন বলে; যে মুরগির গন্ধ আজও তার নাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজও নাকি তিনি একটি দেশি মুরগি কিনে খেতে পারেননি’। নিশ্চয় তিনি গণমাধ্যমের সামনে অতিরঞ্জিত এবং নিজেকে ভাইরাল করতে এমন বক্তব্য দিয়েছেন– সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ আমাদের দেশি মুরগির দাম এতো বেশি না যে; ২০ বছরেও সে মুরগি কিনে খেতে পারবে না।
শিক্ষকদের প্রতিটি শব্দের গভীরতা অনেক বেশি। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ মার্জিত এবং তার মধ্যে দায়িত্ববোধ থাকা দরকার। তাদের কাছ থেকে আমরা নৈতিক জ্ঞান অর্জন, সামাজিকতা পালন এবং দূরদর্শিতার প্রতিফলন আশা করি। এ জায়গা কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। যদি এমন হেঁয়ালিপূর্ণ বা মনগড়া বক্তব্যে পুরো শিক্ষক সমাজ সমার্থন করেন তাহলে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, শিক্ষকতা পেশা তার সম্মান হারাবে এবং এ পেশায় আরও সংকট দেখা দিবে। এদিকে শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে সরকারের আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করাসহ তাদের নায্য অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে তাদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার জায়গা তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন ও আর্থিক সুবিধা বাড়িয়ে এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষকরা যেন আপন মনে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে কাজ করে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বার বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে, শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করে বাচ্চাদের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে দেওয়া যাবে না। আশা রাখি, সরকার দ্রুতই শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরাতে সক্ষম হবেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের দিকে সুনজরসহ যাবতীয় সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা
বিকেপি/এমবি

