বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের ইতিহাসে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান নিঃসন্দেহে অনন্য। গ্রামীণ নারীশক্তিকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করা থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস হওয়া পর্যন্ত—এই খাত দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছে, লাখ লাখ মানুষের জীবনে আয় ও স্বনির্ভরতার পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করছে—কেবল একটি খাতের ওপর নির্ভর করে কি বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে?
বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উৎপাদন ব্যয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন—সব কিছুই বাজারের আচরণকে প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে বদলে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় একমুখী রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতিতে। তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আজ বাংলাদেশের জন্য সেই ঝুঁকির বাস্তব উদাহরণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের গড় মূল্য কমছে, ক্রেতাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ছে, এবং কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মুনাফার পরিমাণ কমে আসছে স্বভাবতই। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সংকট, পশ্চিমা বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া কিংবা মহামারির পরে অর্থনৈতিক ধকল—এসব ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে একক খাতনির্ভরতা অর্থনীতিকে কত সহজেই অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশ যখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সেখানে আয় ও প্রবৃদ্ধির উৎস হতে হবে বহুমাত্রিক। শুধুমাত্র নিম্নমূল্যের পোশাক রপ্তানি দিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার মধ্যেই তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার—যেসব খাত এখনই সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরবর্তী অর্থনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে।
ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে নতুন পরিচিতি দিয়েছে। দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধ আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করি—এটি শুধু শিল্প সক্ষমতা নয়, আত্মনির্ভরতার সুস্পষ্ট সূচক। বাংলাদেশ এখন প্রায় ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন থেকে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা উন্নতমানের ও নতুন ওষুধ তুলনামূলক কম খরচে উৎপাদনের সুযোগ দিচ্ছে। যদি আমরা নিয়মকানুনের মানোন্নয়ন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারি, তবে এই খাত বাংলাদেশের রপ্তানি কাঠামোর নতুন প্রধান স্তম্ভে পরিণত হতে পারে।
একই সঙ্গে হালকা প্রকৌশল শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সুযোগ। দেশের ভেতরেই লোহা, ধাতব জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালি পণ্য, মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলি, সোলার প্রযুক্তি, কৃষি যন্ত্রাংশের বিশাল বাজার রয়েছে। ওপর দিয়ে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন—বিশেষত ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল—অনেক দেশে বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজে নিতে বাধ্য করছে। এখানে বাংলাদেশ একটি বাস্তব পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি হালনাগাদ, ডিজাইন দক্ষতা বৃদ্ধি ও আরএন্ডডিতে (জ্উ) বিনিয়োগ। তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং খাত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। আমরা এখন বিশ্বের অন্যতম বড় ফ্রিল্যান্সিং হাব। কিন্তু সময় এসেছে আরো উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কাজের দিকে এগোনোর—সফটওয়্যার উন্নয়ন, সাইবার নিরাপত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা অ্যানালিটিক্স ও আউটসোর্সিং খাতে বিনিয়োগ করা গেলে এই খাত বছরে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শিল্পও রপ্তানি বৃদ্ধির বাস্তব ক্ষেত্র। আমাদের কৃষি উৎপাদন শক্তিশালী, কিন্তু মূল্য সংযোজনের ঘাটতি রয়েছে। আধুনিক কোল্ড চেইন, খাদ্য নিরাপত্তা সার্টিফিকেশন ও আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং ব্যবস্থার উন্নতি হলে হিমায়িত খাবার, ফল, সবজি, মসলা ও রেডি-টু-কুক খাদ্য বিশ্ববাজারে উল্লেখযোগ্য রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে।
সুতরাং, সম্ভাবনার পরিধি বিস্তৃত। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—আমরা কি এই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রস্তুত? সম্ভাবনা আছে, বাজার আছে, মানবসম্পদও আছে— এখন প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নীতি, দক্ষ এবং ব্যবহারিক মানবসম্পদ তৈরি করা, ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজ করা এবং আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষতার ঘাটতি। শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মুখস্থনির্ভর সনদকেন্দ্রিক; এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীদের বড় অংশই বাজারের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। নীতিগত জটিলতা এবং প্রশাসনিক বিলম্ব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি বন্দর ও পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা দেশের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাকে কমিয়ে দেয়।
এই জায়গাতেই বাংলাদেশকে নিতে হবে সুপরিকল্পিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ। শুধুমাত্র সম্ভাবনার আলোচনা নয়, বরং বাস্তব কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। প্রথমেই আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করলেও শিল্পখাতের বাস্তবিক চাহিদার সঙ্গে তাদের দক্ষতার মৌলিক বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান। শ্রমবাজারের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা—এসব ক্ষেত্রেই বড় ঘাটতি রয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও দক্ষতা উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে হবে, পাঠ্যসূচি আপডেট করতে হবে এবং শিল্পখাতের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরাসরি অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। শিল্প-সংযুক্ত ইন্টার্নশিপ এবং অ্যাপ্লাইড রিসার্চ বাধ্যতামূলক করা হলে শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার আগেই বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন।
একই সঙ্গে শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে জমি বরাদ্দ, পরিবেশ ছাড়পত্র, মূলধন অনুমোদন, কর পরিশোধ ও লাইসেন্সিং—এগুলোর প্রক্রিয়া অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় জটিল ও দীর্ঘ হয়। এই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা শুধু বিনিয়োগকারীর সময় ও খরচই বাড়ায় না, বরং বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি নেতিবাচক বার্তা পাঠায়। তাই এখানে “ওয়ান-স্টপ সার্ভিস”কে কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবিক অর্থে কার্যকর করা প্রয়োজন, যেখানে ব্যবসা শুরু করার প্রতিটি অনুমোদন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন হবে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হবে, এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত থাকবে।
এই নীতিগত সংস্কারের পাশাপাশি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে (ঝঊত) সত্যিকার অর্থে শিল্পায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এসব অঞ্চলে কেবল জমি বরাদ্দ দিলেই হবে না; সেখানে প্রয়োজন স্থায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ, গ্যাস, ইন্টারনেট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবহন সংযোগ এবং নিরাপত্তা—সবকিছু আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা। একই সাথে, এসব অঞ্চলে কর অবকাশ ও বিনিয়োগ প্রণোদনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি প্রশিক্ষণের জন্য ইনস্টিটিউশন স্থাপন করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা শ্রমশক্তি নিয়োগে বাধার সম্মুখীন না হন।
পরিশেষে, বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার জন্য বন্দর, রেল ও মহাসড়ক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ অপরিহার্য। একটি পণ্য উৎপাদনের খরচ যত কমই হোক, যদি তা দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে বাজারে পৌঁছে তা বৃদ্ধি, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর দ্রুত বাস্তবায়ন, রেলওয়ে ও অভ্যন্তরীণ মালবাহী কাঠামো শক্তিশালী করা—এসব এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, কাস্টমস প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আধুনিক করা হলে লজিস্টিকস ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
বাংলাদেশ ইতিহাসের এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনর্গঠিত হচ্ছে। চীন প্লাস ওয়ান কৌশলের কারণে অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নতুন বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্রের সন্ধান করছে। এটাই বাংলাদেশের জন্য সুবর্ণ সুযোগ—যদি আমরা প্রস্তুত হতে পারি। সিদ্ধান্তটি এখন আমাদের—আমরা কি শুধু তৈরি পোশাকের দেশ হয়ে থাকব, না কি আগামীর শিল্প বিপ্লবে নিজেদের নতুন অবস্থান তৈরি করব।
দূরদর্শিতা, পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং সাহস—এই পাঁচটি উপাদানই এখন সবচেয়ে প্রয়োজন। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ কেবল রপ্তানির বৈচিত্র্য অর্জনই করবে না, বরং এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে না—তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
masud.news1@gmail.com
বিকেপি/এমবি

