পরিবার থেকে রাজনীতি
বাংলাদেশের সামাজিক ও নৈতিক চিত্র
রহমান মৃধা
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯
বাংলাদেশের পরিবার এবং সমাজ জীবনে সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত সংকটগুলোর একটি হলো সম্পত্তি বণ্টন এবং উত্তরাধিকার। বাবা মা জীবদ্দশায় খুব কমই তাদের সন্তানদের মধ্যে সম্পদ সুষ্ঠু ভাবে ভাগ করে দেন। সব দায়িত্ব রেখে যান মৃত্যুর পরের জন্য। আর তখন শুরু হয় আজীবনের জন্য কামড়া কামড়ি, রাগ, অভিমান, মামলা মোকদ্দমা এবং সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দুঃখজনক ঘটনা। একটি পরিবার যা সারাজীবন একসাথে থেকেছে, একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অতীতের স্মৃতি ভুলে ঘৃণা আর দূরত্বে আটকে যায়। অথচ এই সংকট নিয়ে সমাজে প্রায় কোনো আলোচনা নেই।
পরিবারে কলহ, জমিজমা নিয়ে মারামারি, পুলিশ কাচারি এবং সালিশের মতো প্রবণতা প্রতিনিয়ত ঘটে, কিন্তু কেউ তা প্রকাশ্যে বলে না। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিয়ে কথা বলতে কারও কোনো সংকোচ নেই। কথায় আছে, আম গাছের তলে তো আমই পড়ে। জাতি যেমন হয় তার নেতৃত্বও তেমন হয়। পরিবার থেকে শুরু হওয়া অগোছালো মনোভাবই রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আসা যাক দেশের রাজনীতির বাস্তবতায়।
বাংলাদেশের রাজনীতি: অসুস্থ নেতৃত্ব এবং বিকৃত কর্মীবাহিনী
খালেদা জিয়া নিজে হাঁটতে পারেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। বয়স এবং শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাকে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় হাসপাতালে। মস্তিষ্কও এখন আগের মতো সক্রিয় নয়, এজন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যম থেকে দূরে। তারপরও তিনি এবার তিনটি আসনে লড়বেন। তার আমলে বাংলাদেশ পাঁচ বার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
রওশন এরশাদও দীর্ঘদিন ধরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না, তবুও দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে তিনি যে কামড়া কামড়ি করেছেন তা দেশবাসী দেখেছে। জাতীয় পার্টির সময় তাকে স্বর্ণ পাচারের হোতা হিসেবে আমরা সবাই চিনতাম। এরশাদও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলীয় ক্ষমতা ছাড়তে চাননি এবং দুর্নীতির দায়ে বহু বছর কারাগারে ছিলেন।
শেখ হাসিনার বয়সও অনেক হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হারানোর পর তিনি এখন ভারতে আছেন। যাওয়ার আগে বহু মানুষ নিহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে। এখন আবার ক্ষমতায় ফেরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তার একদল অন্ধ সমর্থক এখনো তাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এমনকি তারা মনে করে যে তিনি যদি আবার দেশে ফিরে এসে দেশকে আগুনে পুড়িয়ে দেন তবুও তিনি দেশে এসে ক্ষমতায় বসবেন।
এদের কাউকেই ক্ষমতায় বসালে আর নামানো যায় না। টেনে নামাতে হয়। তাদের প্রত্যেকের পেছনে আছে লাখ লাখ অন্ধভক্ত, যাদের আমরা কর্মী বলে চিনলেও প্রকৃত অর্থে তারা বেকার, সংঘর্ষপ্রিয় এবং সুবিধাবাদী। তাদের কাজ বিরোধী পক্ষের সাথে মারামারি করা আর দল ক্ষমতায় থাকলে চাঁদাবাজি, মাস্তানি এবং দাপট দেখানো। এদের একটি বড় অংশ অশিক্ষিত এবং টোকাই মানসিকতার।
যখন দল ক্ষমতায় আসে, তখন এই কর্মীরাই হয়ে যায় সমাজের কর্তাব্যক্তি। কারও সঙ্গে সামান্য মতবিরোধ হলেই এদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়।
রাজনৈতিক নেতাদের যোগ্যতা একটাই অসততা এবং মিথ্যা বলা। আর কর্মীদের যোগ্যতা নেতাদের তোষামোদ করা। এক সত্য খুব পরিষ্কার এই দেশে কোনো নেতা কখনোই অযোগ্য হয় না। তারা দুর্নীতির শেষ সীমানায় পৌঁছালেও নয়। যতদিন পর্যন্ত এই দেশের দালান্ধ মূর্খ লোভী অসৎ ধান্ধাবাজ টোকাইদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা না যাবে, ততদিন এ দেশ কখনোই আলোর মুখ দেখবে না।
কুসংস্কার ও কুপ্রবৃত্তি দূর করার নীতিগত এবং ব্যবহারিক উপায়সমূহ
কুসংস্কার শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়। এটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, ধর্ম এবং মিডিয়া নীতির সমন্বিত ফল। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে একাধিক ক্ষেত্র জুড়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে কুসংস্কার দ্রুত দক্ষভাবে হ্রাস পায়। নিচে গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য কিছু কার্যকর উদ্যোগ প্রস্তাব করা হলো। এগুলোকে জাতীয় রোডম্যাপ হিসেবে গ্রহণ করলে দ্রুত ফল পাওয়া সম্ভব।-
১. শিক্ষা সংস্কার এবং সমালোচনামূলক চিন্তা বেড়ে তোলা
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সমালোচনামূলক চিন্তার পাঠ্যক্রম এবং তথ্য ও মিডিয়া সাক্ষরতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাছে কারণ নির্ণয়, প্রমাণ যাচাই এবং যুক্তি আচরণ শেখালে বেসিক লজিক গঠিত হয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিন বছরের মধ্যে এই রূপান্তর সূচিত করা সম্ভব।
২. স্বাস্থ্য ও গণসচেতনতা আউটরিচ বাড়ানো
গ্রাম ও শহরের দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক স্বাস্থ্য তথ্য পৌঁছে দিয়ে কুসংস্কারভিত্তিক চিকিৎসা এবং ভুল ধারণার বিরুদ্ধে সরাসরি কাজ করতে হবে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিও সমন্বয়ে টার্গেটেড ক্যাম্পেইন খুব কার্যকর।
৩. ধর্মীয় ও স্থানীয় নেতাদের সংলাপ ও অংশগ্রহণ
ধর্মীয় ও স¤প্রদায়িক নেতারা মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখে। তাদেরকে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশিক্ষণ দিলে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আঞ্চলিক দূত তৈরি করা যাবে। আন্তধর্মিক প্ল্যাটফর্ম এই কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
৪. গণমাধ্যম ও বিনোদন মাধ্যমে দায়িত্বশীলতা ও ইতিবাচক কন্টেন্ট
টেলিভিশন, রেডিও, চলচ্চিত্র এবং অনলাইন কন্টেন্টে তথ্যভিত্তিক নাটক, ডকুমেন্টারি এবং প্রোগ্রাম প্রচার করলে সাধারণ মানুষের ধারণা বদলায়। খবরের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ফ্যাক্ট চেকিং জাতীয়ভাবে শক্তিশালী করতে হবে। মিডিয়ার স্বাধীনতা ও দায়িত্ব একসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৫. এনজিও ও সিভিল সোসাইটির শক্তিশালী ভূমিকা
স্থানীয় এনজিও, কৃষি সম্প্রসারণ অফিস, মহিলা সংগঠন এবং স্কুল কমিউনিটি মিলিয়ে মাইক্রো উদ্যোগ চালালে কুসংস্কার ভাঙা সহজ হয়। সফল পাইলট প্রকল্প দ্রুত বিস্তৃত করা উচিত।
৬. আইনগত রক্ষণাবেক্ষণ এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতি শক্তিশালী করা
কুসংস্কারভিত্তিক কাজ মানুষের ক্ষতি করলে দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পুনর্বাসন এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতি শক্ত করা প্রয়োজন।
৭. মূল্যায়ন, মনিটরিং এবং ধারাবাহিক গবেষণা
কোন নীতি কাজ করছে কি না তা মাপা এবং প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতিতে নীতিগুলো সামঞ্জস্য করা জরুরি। স্কুল পর্যায়ের পাঠ্য পরিবর্তন, মিডিয়া ক্যাম্পেইনের কর্মক্ষমতা এবং কমিউনিটি আউটরিচের ফলাফল নিয়মিত মূল্যায়ন করতে হবে।
বাস্তব উদাহরণ: আলফ্রেড নোবেল এবং সমাজকল্যাণমূলক দানশীলতা
আলফ্রেড নোবেলের উদাহরণ কুসংস্কার হ্রাস এবং সমাজোন্নয়নে ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের গুরুত্ব তুলে ধরে। তিনি তাঁর সম্পত্তির বড় অংশ মানবকল্যাণে দিয়ে গেছেন। নিজের চূড়ান্ত ইচ্ছাপত্রে তিনি নির্দেশ করেছিলেন তাঁর সম্পদকে বিশ্বমানবতার অগ্রগতিতে ব্যবহার করতে। নোবেল পুরস্কার আজ বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শান্তিতে বিশ্বমানের স্বীকৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে এক বিশাল ভূমিকা পালন করছে। এটি দেখায় যে ব্যক্তি যখন নৈতিক ও সমাজমুখী সিদ্ধান্ত নেয় তখন সেটি প্রজন্ম ধরে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
এ ধরনের আরও বহু উদাহরণ আছে যেখানে ধনী ব্যক্তিরা সামাজিক প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করে বড় পরিবর্তন এনেছেন। এগুলো আমাদের শেখায় যে ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ এবং সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তুললে কুসংস্কারের জায়গা দখল করে নেয় জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং মানবিক মূল্যবোধ।
সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শিক্ষা: সুইডেন থেকে গ্রহণযোগ্য আচরণ
সুইডেনে আমি নিজ চোখে দেখেছি অনেক প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক জীবন শেষে সাধারণ কাজে ফিরে গেছেন। এমন দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর আস্থাবান্ধব ভাব তৈরি করে। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়। অনেকে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে আমি যখন চার বা আট বছরে কিছু করতে পারিনি তখন পরবর্তীতে কীভাবে পারব। অথচ বাংলাদেশে তারা সর্ব কালের গ্রীন এভার, যার ফলাফল দেশ এবং দেশের অবস্থা এবং পরিকাঠামো দেখলেই বোঝা যায়।
গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ: তিন বছরের লক্ষ্য
প্রথম ছয় মাস
ন্যাশনাল টাস্কফোর্স গঠন যেখানে থাকবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মীয় নেতা, মিডিয়া এবং এনজিও প্রতিনিধিরা।
দুই জেলায় স্কুল পাঠ্য সংস্কার এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যসচেতনতা অভিযানের পাইলট প্রকল্প শুরু।
ছয় থেকে আঠারো মাস
পাইলট মূল্যায়ন করে উন্নত করা এবং বিস্তৃত করা।
গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রচারাভিযান চালু।
ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ এবং জনগণের সঙ্গে সংলাপের ব্যবস্থা।
আঠারো থেকে ছয়ত্রিশ মাস
পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে সংস্কার প্রয়োগ।
যেখানে প্রয়োজন আইনগত সংস্কার শুরু।
জাতীয় পর্যায়ে মূল্যায়ন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু।
উপসংহার ও আহ্বান
কুসংস্কার দূর করা একটি সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, রাজনৈতিক এবং নীতিগত নির্মাণ কাজ। একক কোনো উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সরকার, গণমাধ্যম, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, এনজিও এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে এগোতে হবে। আলফ্রেড নোবেলের দৃষ্টান্ত দেখায় কিভাবে একজন ব্যক্তি সমাজকল্যাণে সম্পদ বিনিয়োগ করে ইতিহাস বদলে দিতে পারেন। সুইডেনের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা দেখায় কিভাবে স্বচ্ছতা এবং সীমাবদ্ধতা স্বীকার করার মাধ্যমে সমাজকে স্থিতিশীল রাখা যায়।
বাংলাদেশ যদি শিক্ষা, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে তুলতে পারে তাহলে কুসংস্কার টিকতে পারবে না। উদ্যোগটি সময়সাপেক্ষ, কিন্তু সম্ভব। শুরু করতে হবে এখনই।
লেখক : গবেষক এবং লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, Pfizer, Sweden
rahman.mridha@gmail.com
বিকেপি/এমবি

