গ্রামের নবজাগরণ : রেমিট্যান্স, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ত্রিমুখী প্রভাব
ওসমান গনি
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০০
দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গ্রামের ভূমিকা ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, যা একসময় জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ জোগান দিত। সেই চিরায়ত গ্রামীণ দৃশ্যপট আজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। গ্রামের অর্থনীতিতে এসেছে এক বিপ্লবী জাগরণ, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দিচ্ছে নতুন গতি। একসময় যেখানে দরিদ্রতা, সীমিত সুযোগ আর বিচ্ছিন্নতা ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেখানে এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া, উন্নত জীবনযাত্রার আকাক্সক্ষা এবং এক নতুন অর্থনৈতিক উদ্দীপনা। এই পরিবর্তন শুধু সংখ্যাগত নয়, গুণগতও বটে, যা গ্রামীণ মানুষের জীবনমান ও ক্ষমতায়নে রাখছে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। এই রূপান্তর বহুবিধ কারণের ফল। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ব্যাপক প্রবাহ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। এই ত্রিধারার সমন্বয় গ্রামীণ সমাজকে কৃষি-নির্ভরতা থেকে বের করে এনে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতির ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী করছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কর্মরত কোটি প্রবাসীর পাঠানো অর্থ গ্রামীণ পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে মজবুত করেছে। এই অর্থ কেবল পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। প্রবাসীদের অর্থায়নে গ্রামে গ্রামে তৈরি হচ্ছে আধুনিক বহুতল ভবন, উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, এবং ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ল²ীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং সিলেট অঞ্চলের অনেক গ্রাম আজ শুধুমাত্র রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে শহরের কাছাকাছি জীবনযাত্রার মান অর্জন করেছে। এই অর্থের প্রবাহ অসচ্ছল পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে এনেছে, তৈরি করেছে স্থানীয় বাজারে নতুন চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এবং ভোগ-ব্যয়ের বৃদ্ধি অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে।
তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে (যেমন বাড়ি নির্মাণ বা ভোগ্যপণ্য ক্রয়) ব্যয় হয়। তাই এই অর্থকে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কুটির শিল্প এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোগে (এসএমই) বিনিয়োগের দিকে চালিত করার জন্য সুচিন্তিত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি আরও টেকসই হবে। রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এর ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও দ্রুত উন্নত হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন গ্রামীণ অর্থনীতিকে শহুরে বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছে। গ্রামীণ সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের ফলে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য এখন দ্রুত এবং কম খরচে বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। আগে যেখানে পণ্য নিয়ে যাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল, সেখানে এখন ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হওয়ায় কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। উন্নত সড়ক যোগাযোগ একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে, যা স্থানীয় কৃষি পণ্য, মাছ ও সবজিকে জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে। দ্রুত সংযোগের ফলে পচনশীল পণ্যের অপচয় কমেছে এবং কৃষকদের লাভ বেড়েছে।
একই সঙ্গে, শতভাগ বিদ্যুতায়ন গ্রামীণ জীবনে এনেছে এক নতুন আলোর ছটা। বিদ্যুৎ শুধু ঘরে আলো জ্বালায়নি, বরং তা গ্রামে শিল্পায়ন, আধুনিক কৃষিব্যবস্থা ও সেবা খাতের জন্ম দিয়েছে। বিদ্যুৎচালিত গভীর নলকূপ সেচ ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে, ধানকল ও ছোট ছোট কারখানা স্থাপনকে উৎসাহিত করেছে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে। এর ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এই পরিবর্তন গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথে এক ধাপ অগ্রগতি। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং অনলাইন লেনদেনের সহজলভ্যতা গ্রামীণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে বহুলাংশে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি কৃষি খাতও আজ আর সেই চিরায়ত পদ্ধতিতে আটকে নেই। কৃষিতে এসেছে আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণ। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগের ফলে উন্নত বীজ, সার এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান, পাট বা গমের মতো চিরাচরিত ফসলের পাশাপাশি কৃষকরা এখন উচ্চমূল্যের অর্থকরী ফসল যেমন- বিভিন্ন প্রকার সবজি, ফলমূল, মাছ, হাঁস-মুরগি এবং দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে ঝুঁকছে।
এই বহুমুখীকরণ গ্রামীণ আয়ের উৎসকে স্থিতিশীল করেছে এবং কৃষকদের মৌসুমী ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করেছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ এই খাতকে আরও বেশি লাভজনক করে তুলছে। কৃষিপণ্যকে কাঁচা বিক্রির পরিবর্তে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বাজারজাত করা গেলে উৎপাদকদের আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করবে। কৃষি এখন কেবল টিকে থাকার মাধ্যম নয়, বরং একটি লাভজনক বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিয়েছে এবং ফলন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের কৃষি-সহায়তা নীতি ও প্রণোদনা এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একসময় কৃষি-বহির্ভূত আয়ের উৎস ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু বর্তমানে কুটির শিল্প, হস্তশিল্প এবং গ্রামীণ সেবা খাতের ব্যাপক বিকাশ ঘটছে। স্থানীয় বাজার, ক্ষুদ্র ব্যবসা, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসার গ্রামের মানুষের আর্থিক লেনদেনকে সহজ করেছে। ভিলেজ ডিজিটাল বুথ-এর মতো উদ্যোগগুলো গ্রামীণ মানুষকে ব্যাংকিং এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সেবার আওতায় এনেছে, যা গ্রামীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। গ্রামীণ এলাকায় ছোট ছোট উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠছে, যা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধিও এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ক্ষুদ্রঋণ, সরকারি প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ নারীরা এখন কৃষি, পশুপালন, কুটির শিল্প এবং স্থানীয় ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত হচ্ছেন। তাদের এই অংশগ্রহণ পারিবারিক আয় বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। গ্রামের বাজারে আধুনিক শপিং মল, রেস্তোরাঁ, ফার্মেসি, এবং ছোট ছোট ওয়ার্কশপের উপস্থিতি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনশীল চিত্রকেই তুলে ধরে। গ্রামীণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগ বেড়েছে, যা মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়ক। গ্রামীণ অর্থনীতির এই দ্রুত পরিবর্তন নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক হলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। দক্ষ শ্রমিকের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের স্বল্পতা এর মধ্যে প্রধান। তাছাড়া, গ্রামীণ মানুষের মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং আর্থিক সেবা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবও একটি বাধা। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস করা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি গ্রামীণ অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক নীতি, যেখানে গ্রামকে অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কৃষিকে শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজে পরিণত করা, অর্থাৎ কৃষি খাত থেকে শিল্প খাতের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করা, ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, গ্রামীণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা গেলে গ্রামীণ শিল্পায়ন আরও গতি পাবে। পরিবর্তনশীল এই গ্রামীণ অর্থনীতি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনছে না, বরং দারিদ্র্য বিমোচন এবং একটি সুষম সমাজ গঠনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে, যেখানে গ্রাম হবে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই পরিবর্তন শুধু অর্থনীতির চিত্র বদলাচ্ছে না, এটি বদলে দিচ্ছে কোটি কোটি গ্রামীণ মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, যা একটি উন্নত বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিকেপি/এমবি

