শুল্কের খেলায় একটি বল নিজের কোর্টে পেতে রাশিয়াকে কাছে দরকার ছিল ভারতের। এবং পাকিস্তানে অপারেশন সিঁদুরের পর ভারতের দুর্বল দিকগুলোও সামনে বেরিয়ে আসে। প্রতিরক্ষা খাত যে আরও উন্নত করা দরকার সেটি সামনে আসে। বিশ্বজুড়ে যখন আলোচনায় ঝড় তোলে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান যা চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোণা কয়েকটি দেশের কাছেই রয়েছে। চীনের তৈরি এই জে-৩৫এ যুদ্ধবিমান হলো দ্বিতীয় পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ ফাইটার জেট। এটি মাঝারি আকারের বহুমুখী যুদ্ধবিমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী। যেখানে ভারতের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী চীন ভারতের থেকেও সামরিক কাঠামো অধিক শক্তিশালী করেছে। ফলে ভারতের সামনে নিজের প্রতিরক্ষা খাত আধুনিক করার বিকল্প নেই। বিশেষত যখন পাকিস্তানও একই পথে হাঁটছে।
গত বছরের শেষদিকে এক সংবাদে জানা যায়, পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক ৪০টি স্টিলথ যুদ্ধবিমান কিনতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে পাকিস্তন। চীনের তৈরি জে-৩৫এ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের কাছে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভারসাম্য পাল্টে যাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এই খবরের পরেই নড়েচড়ে বসে ভারতের প্রতিরক্ষার কর্তা ব্যক্তিরা। সেখানে ভারত যে পিছিয়ে থাকতে চাইবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। শক্তির ভারসাম্যে পিছিয়ে থাকা মানে হলো পক্ষান্তরে দুর্বল থাকা। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের উপর নাখোশ। বাকি থাকে রাশিয়া। দেশটি ভারতের সাথে এর আগেও প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। তাছাড়া কোনো দেশ তখনই পরাশক্তি হতে পারে যখন সেই দেশের হাতে পর্যাপ্ত আধুনিক সমরাস্ত্রের সাথে সাথে অর্থনীতি ও বাণিজ্য একটি শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় অবস্থানে থাকে।
এ তো গেলো সামরিক বিশ্বে নিজেকে জানান দেওয়ার চ্যালেঞ্জের কথা। ভারতের অর্থনীতিও আমেরিকার খাড়ায় জ্বলছে। বিশ্বে রাজনৈতিক সমীকরণ রং বদল করছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই এই রং বদলের খেলা শুরু হয়েছে। ইউক্রেন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যেকার শক্তিমত্তা জাহির করার ফুটবল মাঠ। জ্বালানি তেল কেনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের খড়গ মাথায় নিয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রায় যুদ্ধ করছেন তখন রাশিয়া বরাবরের মতোই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই রাশিয়ার সাথে ভারতের সুসম্পর্ক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও রাশিয়ার সমর্থন ছিল আকুণ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর যখন দেশের ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছিল তখন রাশিয়ার নৌবহর দেখেই তা পিছু হটে। না হলে ভারতের পক্ষে পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতো। অথবা ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। ভূরাজনৈতিক ঘেরাটোপে ভারতের সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক সম্ভবত রাশিয়ার। এই দুই মিত্র দেশের জোট এতটাই শক্তিশালী যে এর সাথে আরও কয়েকটি দেশের সুসম্পর্ক রীতিমতো পশ্চিমা দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ। তাছাড়া দুই বলয়ের অবস্থানও প্রায়ই বিপরীত। ইদানিং ভারতের সাথে চীনের সম্পর্কও বেশ ভালো হয়েছে। অন্তত আগের থেকে ভালো হয়েছে। ভারত-রাশিয়া-চীন এই ত্রিমিত্র দেশের চাপ নিশ্চয়ই ট্রাম্পকেও ভাবাচ্ছে। এত শুল্ক আরোপ করার পরেও কেন রাশিয়ার সাথে এত সুসম্পর্ক সেটাও নিশ্চয়ই প্রশ্নের! এই চিন্তার মধ্যেই আরও সম্পর্ক গাঢ় করতে পুতিন সফর করলেন ভারতে।
বিশ্লেষকরা এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। কী কী লাভ ভারতের হয়েছে। আর রাশিয়ার কত কাছে আসতে পেরেছে ভারত। পুতিনের এই সফর এমন এক ব্রহ্ম মুহূর্তে যখন মোদি নিজ দেশেও শুল্ক নিয়ে চাপে রয়েছেন। সামনের নির্বাচনে আলোচনায় আছে ভারতের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম ভারতে এলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ধারণা করাই হয়েছিল পুতিনের আলোচনার মূল বিষয় থাকবে তিনটি। প্রথমটি বাণিজ্য, দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা আর কূটনীতি। বাণিজ্য ভালোভাবেই আলোচনায় এসেছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু রাখতে সম্মত হয়েছে ভারত ও রাশিয়া।
২০২০ সালে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০২৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে যা এসে দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে একটা বিরাট অঙ্ক হল সস্তার রাশিয়ান ক্রুড অয়েল। রাশিয়া চাইছে আগামী পাঁচ অর্থবর্ষে অর্থাৎ ২০৩০ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এই অঙ্কটাকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে। কূটনৈতিকরা মনে করছেন একদিকে রাশিয়া যেমন এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে চাইছে, তেমনই এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই নয়া দিল্লিও। কারণ একটাই, ভারত ও রাশিয়ার বাণিজ্য ঘাটতি।
স্পষ্ট করে বললে ভারত মাত্র চার দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য পাঠায় পুতিনের দেশে। অন্যদিকে, প্রায় ৬৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রাশিয়া থেকে ভারতে আসে। ভারত ৭৫ মিলিয়ন ডলার করে মোবাইল ফোন ও চিংড়ি, ৬৩ মিলিয়ন ডলারের মাংস ও প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে রাশিয়ায়। এই বিশাল ঘাটতি পূরণ করতে পুতিনের সাথে আলোচনার দরকার ছিল। অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বাড়াতে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই আপাতত। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত বরাবরই ছিল মধ্যপন্থায়। মোদি নিজেকে শান্তির পক্ষে ধরে রেখেছেন। সেখানে সরাসরি কোনো মন্তব্য আশাও করা হয়নি। যুদ্ধ থামাটা কেবল পুতিনের হাতেই রয়েছে এটা বেশ বোঝা গেছে। পুতিন ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল ছাড়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ একটি টার্গেট যা রাশিয়া ইউক্রেনে পূরণ করতে চায়।
সেটা হওয়া পর্যন্ত কিছু হবে বলে মনে হয় না। প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে বেশ আশাবাদ ছিল। কারণ ভারতের প্রতিরক্ষা খাত আরও শক্তিশালী করতে রাশিয়াকে প্রয়োজন। ভারতের আধুনিক বেশিরভাগ অস্ত্রই রাশিয়ার প্রযুক্তি। আরও আধুনিক প্রযুক্তি পেতে তাই রাশিয়ার কাছেই যেতে হবে। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ব্যবহার করা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার তৈরি যা বেশ কার্যকর ছিল। ভারতের দরকার পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেট। কারণ পাকিস্তান নাকি চীনের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান কিনতে চলেছে। ফলে ভারতও পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। আর সেক্ষেত্রে প্রধান ভরসার জায়গা রাশিয়া। যদিও সেসব কিছু হয়নি বলেই জানা গেছে। এ দফা সফরে সেটা না হওয়াটা মোদির জন্য বেশ হতাশার।
ভারতের উপর শুল্ক আরোপের পর থেকেই রাশিয়া ভারতকে মানসিকভাবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র যে পথেই হাঁটুক মিত্র হিসেবে যেমন চীনের সাথে আছে, সেভাবে ভারতের পাশেও রয়েছে। এই সফরেও সেই বার্তা স্পষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথেও রাশিয়ার সম্পর্ক নড়বড়ে হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো যেভাবে জোটবদ্ধ হয়ে রাশিয়ার সমালোচনা করছে তখন ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে পুতিনের পাশে রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক শত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এটাও একটা কৌশল। ভূরাজনীতির খেলায় চীন-রাশিয়া এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশই পরাশক্তি এবং অস্ত্রশস্ত্রে পূর্ণ। সম্পর্ক ভারসাম্য করার রাজনীতি জোরেসোরেই চলছে। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ অ্যান্ড টেক নীতি। এখানে উদারনীতি বলে কিছু নেই। রয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড়। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে। তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক, বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তা ছাড়া রয়েছে ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়। কে পৃথিবীর মুরুব্বী হয়ে খবরদারি করবে, তার সাথে কোন কোন দেশ থাকবে, তাদের স্বার্থ রক্ষার উপায় কি হবে এসব বিষয়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতি গরম হয়ে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই এই প্রতিযোগিতা চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত ও চীনের ভেতর।
সামরিকয়ান, বাণিজ্য, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে ভারতকে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম, অর্থনীতি এবং কূটনীতি শক্তিশালী করতেই হবে। ট্রাম্পের সাথে চলমান দ্ব›দ্ব খুব সম্ভবত এত দ্রুত মিটছে না। যদিও এরই মধ্যেই দুই দেশ আলোচনা করেছে কিন্তু শুল্কের বিষয়ে কোনো সমাধান আসেনি। তবে সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার সাথে যা ট্রাম্পেরও দুশ্চিন্তার কারণ। পুতিনের সফরে যতটুকু চুক্তিই হোক, কেবল সফরের ফলেই বর্হিবিশ্বে উভয় দেশের একটি শক্তিশালী বার্তা যাচ্ছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
বিকেপি/এমবি

