সূচিশিল্পের বিশ্বযাত্রা : নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক
ফারজানা জিতু
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:২৭
বাংলাদেশের শিল্পঐতিহ্যে সূচিশিল্প একটি অপরিহার্য অংশ। এটি কেবল গৃহসজ্জা বা পোশাক অলংকরণের উপকরণ নয়, বরং গ্রামীণ নারীর জীবনের দর্শন, প্রেম, বিশ্বাস, দুঃখ ও আনন্দের ইতিহাসেরও ধারক। সূচিশিল্পে যে কারুকার্য ফুটে ওঠে, তা নারীর কল্পনা, স্মৃতি ও শিল্পসত্তার একান্ত প্রকাশ। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনের অনুভূতি একত্রে বোনা থাকে সূঁচের প্রতিটি বুননে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
বাংলার সূচিশিল্পের শেকড় বহু প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব যুগে বয়নশিল্পের সঙ্গে সূচিকর্মের অস্তিত্ব প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন বঙ্গের তাঁত কাপড়ে সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারির চিহ্ন পাওয়া গেছে। যদিও এসব নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও বইয়ের সূত্রে জেনেছি।
মুঘল আমলে সূচিকর্ম এক অভিজাত শিল্পে পরিণত হয়। মসলিনের উপর সূক্ষ্ম জারদৌসি সূচিকর্ম, দরবারি পোশাক, চাদর ও ওড়নায় সূচির গৌরবময় ছাপ রাখে। সে সময় মুঘল নারীরাও সূচিশিল্পে দক্ষ ছিলেন এবং এই শিল্প ধীরে ধীরে গ্রামীণ বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, পুরনো শাড়ি ও ধুতি পুনর্ব্যবহার করার প্রয়োজনে বাঙালি নারী নকশিকাঁথা নির্মাণ শুরু করে। যদিও এর ইতিহাস নিশ্চিতভাবে জানা যায় না, তবে আমার বিশ্বাস— নকশিকাঁথা ছিল নারীর আত্মকথন, শিল্প ও স্মৃতির গোপন ভাষা।
একেকটি কাঁথা যেন একেকটি জীবন্ত ইতিহাস— বিয়ের কাঁথায় প্রেম, সন্তানের জন্মকথায় মাতৃত্ব, তীর্থদর্শনের স্মরণে ধর্মবিশ্বাস। ব্রিটিশ আমলে সূচিশিল্পকে 'ক্ষুদ্র লোকজ শিল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, জমিদার ও শহুরে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সূচিকর্মবিশিষ্ট ওড়না, গহনা সেট ও চাদরের কদর ছিল। ইউরোপীয় ক্রসস্টিচ ও কাটওয়ার্কও এ সময় বাংলা সূচিশিল্পকে প্রভাবিত করে।
স্বাধীনতা-উত্তর সূচিশিল্প ও অর্থনীতিতে প্রভাব
১৯৭১ পরবর্তী সময় থেকে সূচিশিল্প নতুন অর্থনৈতিক গতিপথে প্রবেশ করে। BRAC, কারিতাস, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, আড়ং, প্রবর্তন-এর মতো সংস্থাগুলি নারীর আর্থিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে সূচিশিল্পকে পেশাদার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলায় ভূমিলা রাখে। গোষ্ঠীভিত্তিক উৎপাদন মডেলের মাধ্যমে গ্রামে তৈরি ও শহরে বিপণনের মাধ্যমে একটি অর্থনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে।
সূচিশিল্পে প্রোডাকশন লাইন নেই— প্রতিটি পণ্য হাতে তৈরি, যা একে মানবিক ও শিল্পমূল্যযুক্ত করে তোলে। সূচিশিল্প কেবল নকশিকাঁথায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি এখন সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, বেডকভার, ওয়ালম্যাট, ব্যাগ, জুয়েলারি, জুতা, টেবিল রানার প্রভৃতি বহুবিধ পণ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমানে জামদানি, কাঁথা, জারদৌসি, ক্রসস্টিচ, এপ্লিক, গুজরাটি, সাবুদানা, কাথা স্টিচসহ বিভিন্ন ধাঁচের সূচিকর্ম মিশ্রিত কাজ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক স্থান করে নিয়েছে।
অর্থনৈতিক অবদান ও নারীর ক্ষমতায়ন
UNDP ও ITC-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, হস্তশিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৬০%-এর বেশি। সূচিশিল্প নারীর পছন্দ থেকে পেশা এবং পেশা থেকে ক্ষমতায়নের পথে পরিণত হয়েছে। এককালে যা ছিল 'ঘরের কোণে বসে করার কাজ', আজ তা 'শো-রুমের স্পটলাইটে'।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
১. Sustainable Fashion ও Slow Fashion Movement
ইউরোপ ও আমেরিকায় হ্যান্ড এমব্রয়ডারির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এদেশের হাতে তৈরি পণ্য টেকসই ফ্যাশনের বাজারে দারুণ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
২. Storytelling Branding
প্রতিটি সূচিকর্মের পেছনে একটি মানুষ, একটি গল্প আছে। শিল্পীর নাম ও জীবনের গল্প তুলে ধরলে সেই পণ্যের গ্লোবাল appeal বহুগুণে বাড়বে।
৩. Tourism Craft Integration
কক্সবাজার, সুন্দরবন, সিলেটের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সূচিশিল্পকে যুক্ত করলে স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও রক্ষা পাবে।
চ্যালেঞ্জ
- মধ্যস্বত্বভোগীর শোষণ
- আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইন ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি
- ডিজিটাল মার্কেটিং সক্ষমতার অভাব
- ব্র্যান্ড প্রোটেকশন না থাকা
- mass machine embroidery-এর কারণে আসল শিল্পী হারিয়ে যাচ্ছে।
করণীয়
- স্কিল ডেভেলপমেন্ট
- ডিজাইন ইনোভেশন
- আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ
- ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে প্রবেশ
- GI ট্যাগিং এবং ব্র্যান্ড পলিসির বাস্তবায়ন।
এখানে GI ট্যাগিং ও ব্র্যান্ড পলিসি নিয়ে একটু আলাদা করেই আলোচনা দরকার বলে মনে করি।
GI (Geographical Indication) কোনো দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে। জামদানি ইতিমধ্যে GI ট্যাগ পেয়েছে, তবে নকশিকাঁথা বা সূচিশিল্প এখনও এই স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। ফলে বিদেশি বাজারে নকল পণ্যের বিস্তার ঘটছে, কিন্তু প্রকৃত কারিগররা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।
সূচিশিল্পের জন্য GI ট্যাগিং জরুরি— কারণ এটা শুধু নকশা নয়, বাংলাদেশের নারীর গল্প, জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির প্রতীক। ভারতের চিকনকারি বা কাশ্মীরের কাশিদার মত GI ট্যাগ পাওয়া পণ্যের বাজারদর ও মূল্যায়ন দ্বিগুণ বেড়েছে।
বর্তমান প্রতিবন্ধকতা
- GI ট্যাগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
- রেজিস্ট্রেশনের জটিলতা
- কোনো শক্তিশালী ব্র্যান্ড পলিসি নেই
- সুযোগসন্ধানী দালালের দখল
- প্রশিক্ষণের অভাব
- তৃণমূল শিল্পীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই।
সমাধানে প্রস্তাব
- GI রেজিস্ট্রেশন সহজ ও ফাস্ট ট্র্যাক করতে হবে
- প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে স্রষ্টার পরিচয় তুলে ধরা
- আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড ও ডিজাইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ
- সরকার-NGO-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে বাজারসংযোগ।
বাংলাদেশ যদি GI ট্যাগিং, ডিজিটাল মার্কেটিং ও ডিজাইন উন্নয়নে বিনিয়োগ করে, তাহলে আমাদের সূচিশিল্পও হয়ে উঠতে পারে একটি বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড। এতে নারী উদ্যোক্তা, গ্রামীণ শিল্পী ও দেশের অর্থনীতি— সব কিছুরই উন্নয়ন ঘটবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের সূচিশিল্প একটি সম্ভাবনার বিশাল খনি। যা একদিকে ইতিহাস, অপরদিকে অর্থনীতি, তৃতীয়দিকে নারীর জীবনযাত্রার প্রতিনিধিত্ব করে। GI ট্যাগ এবং ব্র্যান্ড পলিসির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই শিল্প হতে পারে আমাদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রপ্তানি। একদিন হয়তো 'Made in Bangladesh' লেখা সূচিকর্মে মুগ্ধ হবে সারাবিশ্ব—সেই স্বপ্ন আমরা দেখতে চাই। সদিচ্ছা নিয়ে চেষ্টা করলে স্বপ্নের বাস্তবায়নও হবে নিশ্চয়ই।
লেখক : সূচিশিল্পী; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শিল্পপুরাণ

