জকসু নির্বাচন:
ইশতেহারে প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতা
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৭
দরজায় কড়া নাড়ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রশক্তি ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ নয়টি রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমর্থনে চারটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে তিনটি প্যানেল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তবে জাতীয় ছাত্রশক্তি সমর্থিত 'ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান' প্যানেল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার প্রকাশ করেনি।
ঘোষিত ইশতেহারগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় সব প্যানেলই দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন, আবাসন সংকট নিরসন, ভাতা চালু, গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা, পরিবহন সুবিধা, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মেডিকেল সেন্টারের উন্নয়ন, টিএসসি ও ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের মানোন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত ২১ ডিসেম্বর 'অদম্য জবিয়ান ঐক্য' প্যানেল তাদের ইশতেহার ঘোষণা করে। এতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের কথা উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় চুক্তিভিত্তিক আবাসন ব্যবস্থা এবং শতভাগ আবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত 'বিশেষ বৃত্তি' চালু রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থী অনুপাতে বাজেট বৃদ্ধি, ছাত্রী হল থেকে সরাসরি ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ, টিএসসির মালিকানা জটিলতা নিরসন, ছাত্রী হলে জিমনেসিয়াম স্থাপন এবং পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি তুলে ধরতে উৎসব আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য 'অদম্য মেধাবী বৃত্তি' চালু এবং ক্যাম্পাস সংলগ্ন নিরাপদ এলাকায় আবাসন নিশ্চিত করার আশ্বাসও রয়েছে।
প্যানেলটির জিএস পদপ্রার্থী আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, আমাদের ইশতেহারে বাস্তব সম্মত বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যথাযথ সহায়তা পেলে আমরা এর চেয়েও বেশি কাজ করতে পারবো।
এরপর গত ২৩ ডিসেম্বর ছাত্রদল ও ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত 'ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান' প্যানেল তাদের ইশতেহার ঘোষণা করে। ইশতেহারে ভয়ের সংস্কৃতি দূর করে একটি গণতান্ত্রিক, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। জোবায়েদ হত্যাকাণ্ডসহ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত সব হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিও জানানো হয়।
ইশতেহারে ক্যাম্পাস নিরাপত্তা জোরদারে সিসিটিভি স্থাপন, পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা, ২৪ ঘণ্টার সিকিউরিটি অ্যাপ, আইনি সহায়তা সেল এবং সাইবার বুলিং প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আবাসন সংকট নিরসনে নতুন হল নির্মাণ, অস্থায়ী হোস্টেল, আবাসন ভাতা এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত হল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া একাডেমিক উন্নয়নে সেশনজট নিরসন, ডিজিটাল স্টুডেন্ট পোর্টাল, গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের কথা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক মেডিকেল সেন্টার, স্বাস্থ্য বীমা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
প্যানেলটির এজিএস পদপ্রার্থী বিএম আতিকুর রহমান তানজিল বলেন, আমরা সেসব ইশতেহারই রেখেছি যা আমাদের দ্বারা করা সম্ভব। ইনশাআল্লাহ, আমরা নির্বাচিত হলে প্রতিটি ইশতেহার বাস্তবায়ন করবো।
এরপর ২৪ ডিসেম্বর নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করে মওলানা ভাসানী ব্রিগেড প্যানেল। তাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সংস্কারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত জকসু নির্বাচন এবং সভাপতিকে সরাসরি শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচনের লক্ষ্যে গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত আবেদন ফি, পোষ্য কোটা, শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরোধিতা করা হয়।
ক্যান্টিনে ২০ টাকায় একবেলার খাবার এবং রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলো ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে।
প্যানেলটির জিএস পদপ্রার্থী ইভান তাহসীব বলেন, জকসু একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক বছরে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তবে তারা একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে চান।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
এদিকে প্রার্থীদের ইশতেহারের বিষয়গুলো ইতিবাচক ভাবে দেখছেন শিক্ষার্থীরা। তবে আগামী এক বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে, তাদের প্রতিশ্রুতি কতটুকু পূরণ করতে পারবেন? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আদিবা নওমি বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবেন, তাদেরকে নির্বাচিত করবেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। একইসাথে সকল প্রার্থীকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারকে নির্বাচন প্রতিজ্ঞা হিসেবে নিতে হবে। যা সহজে পূরণ করা যাবে।
লোকপ্রশাসন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তানজিম হাসান বলেন, প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে রেখেছেন, সেসব বাস্তবায়ন করলেই জকসু নির্বাচন সফল হবে।
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব বলেন, প্রথম বারের জকসু নির্বাচনে অনেকটা উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষাথীরা ইতিবাচকভাবে দেখছে। সারদেশে এবং প্রতিটি ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে প্রতিবছর এই নির্বাচনী আয়োজন প্রয়োজন। তবে ইশতেহারের বিষয়গুলো সময় বিবেচনায় রাখা উচিত।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১৬ হাজার ৪৪৯ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ৮ হাজার ৪৭৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ৮ হাজার ১৭০ জন। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট প্রার্থী ১৮৭ জন। নির্বাচনের মোট প্যানেল ৪টি (ছাত্রদল, শিবির, ছাত্রশক্তি ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রান্ট)। সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী ৯ জন, সহসাধারণ সম্পাদক ৮ জন। নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার), এদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।


