Logo

মতামত

আপসহীন খালেদা জিয়া : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের অমর অধ্যায়

Icon

জাহিদ ইকবাল

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:০৮

আপসহীন খালেদা জিয়া : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের অমর অধ্যায়

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে আজ এক গভীর শূন্যতা। যেন ইতিহাসের বুক চিরে নেমে এসেছে দীর্ঘ এক বিষণ্ণ সন্ধ্যা। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী ও গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়ার বিদায় কেবল একজন রাজনীতিকের মৃত্যু নয়— এটি একটি যুগের সমাপ্তি, একটি আদর্শিক সংগ্রামের যবনিকা এবং কোটি মানুষের আশা-ভরসার এক নীরব নিভে যাওয়া প্রদীপ। তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যাঁর জীবন কেবল ক্ষমতার অলিন্দে আবদ্ধ ছিল না; বরং রাজপথ, কারাগার, জনতার হৃদয় এবং ইতিহাসের পাতায় সমানভাবে বিস্তৃত।

১৯৮১ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ যখন জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তখন ৩২ বছরের এক গৃহবধূর ব্যক্তিগত জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কোলে দুই সন্তান— তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। স্বামীহারা সেই নারী চাইলে নিভৃতে হারিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে বেছে নিয়েছিল অন্য এক ভূমিকায়। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি নামলেন রাজনীতির কঠিন ও নির্মম পথে— যখন দেশ ছিল সামরিক শাসনের দখলে, গণতন্ত্র ছিল নির্বাসিত, আর বিএনপি ছিল নেতৃত্বশূন্য।

যিনি কোনো দিন রাজনীতি করেননি, জনসভায় বক্তৃতা দেননি— সেই নারী অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নয় বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি রাজপথে অবিচল ছিলেন। গৃহবন্দিত্ব, কারাবরণ, হুমকি, অপমান— কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছুটে বেড়ানো সেই নেত্রীর কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হতো, ‘আমি জনগণের কাতারে আছি’— তখন তা কেবল স্লোগান ছিল না, ছিল সংগ্রামী মানুষের শপথবাক্য।

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রথম নারী সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি শুধু ইতিহাসই সৃষ্টি করেননি, রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রজ্ঞারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি ছিল— ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ভেঙে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা বাতিল করে তিনি যে ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত। ক্ষমতার মোহ নয়, গণতন্ত্রই ছিল তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

খালেদা জিয়ার শাসনামল মানেই কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়— এটি ছিল এক নীরব সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের সময়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষাই জাতির মুক্তির মূল চাবিকাঠি। তাই মেয়েদের মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করেন, যা নারী শিক্ষায় বিপ্লব ঘটায়। আজ বাংলাদেশের নারী শ্রমশক্তি, নারী নেতৃত্ব ও সামাজিক অগ্রগতির পেছনে এই সিদ্ধান্তের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

তিনি প্রবর্তন করেন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা— যার মাধ্যমে নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় লড়াই শুরু হয়। চালু করেন ‘ডাল-ভাত কর্মসূচি’, যা দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার প্রতীক হয়ে ওঠে।

অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর সাহসী সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল যমুনা বহুমুখী সেতু (বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতু)। এই সেতু কেবল উত্তরবঙ্গকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করেনি, বদলে দিয়েছিল দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্র।

খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম ছিল আপসহীন ও প্রশ্নহীন। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের অস্বাভাবিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁকে যখন দেশত্যাগের প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন— ‘এই দেশই আমার ঠিকানা, এই মাটিতেই আমার মৃত্যু হবে।’ নিজের দুই সন্তানকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন, বিদেশের মাটিতে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু বরণ করেছেন— তবুও দেশ ছাড়েননি। এই আত্মত্যাগ, এই দৃঢ়তা ইতিহাসে বিরল।

জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে তিনি নিক্ষিপ্ত হন এক নির্মম অগ্নিপরীক্ষায়। নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি থাকা, গুরুতর অসুস্থতা, চিকিৎসা নিয়ে টালবাহানা— সবকিছুর মাঝেও তাঁর মনোবল ভাঙেনি। আপস নয়, নতজানু নয়— এই ছিল তাঁর শেষ দিনগুলোরও রাজনীতি। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়; এটি আত্মমর্যাদা ও আদর্শের প্রশ্ন।

খালেদা জিয়া ছিলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের অধিকার রক্ষা করতে হয়। তিনি কেবল বিএনপির নেত্রী ছিলেন না— তিনি ছিলেন রাষ্ট্রচিন্তার এক ধারার নাম, একটি দর্শনের প্রতীক।

আজ ব্যক্তি খালেদা জিয়া নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর সংগ্রাম, তাঁর আপসহীনতা এই দেশের মাটি ও মানুষের চেতনায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, যত দিন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হবে, তত দিন খালেদা জিয়া ফিরে আসবেন প্রেরণা হয়ে, শক্তি হয়ে, পথনির্দেশক হয়ে। তিনি কোনো দলের নন— তিনি ইতিহাসের, তিনি জাতির।

বিদায় দেশনেত্রী। আপনি পরাজিত হননি— আপনি ইতিহাসের চূড়ায় উঠে অমরত্বের পথে হেঁটে গেছেন।

লেখক পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বেগম খালেদা জিয়া

বিদায় খালেদা জিয়া

আরও পড়ুন
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর