Logo

রাজনীতি

একনজরে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ইউসুফ সাদিক হক্কানী

হাফেজ্বী হুজুরের মুখপাত্র

বেলায়েত হুসাইন

বেলায়েত হুসাইন

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৭

একনজরে খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ইউসুফ সাদিক হক্কানী

ছবি : বাংলাদেশের খবর

এ জগতে বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছুই লাভ করা যায় না। প্রতিটি বস্তু হস্তগত করতে এবং প্রকৃত সুখ লাভের জন্য অনেক দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়। এ পৃথিবী একটি সংগ্রামক্ষেত্র। এখানে সুখ ও স্বার্থকতা সহজে লাভ করা যায় না। ফুল যেমন কাঁটায় আবৃত, এ পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তেমন বিভিন্ন দুঃখ ও বাধা-বিপত্তিতে পরিবেষ্টিত। এ দুঃখের জ্বালা সহ্য করে বাধা বিঘ্নকে ঠেলে সরিয়ে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের দ্বারা জীবনে সুখ পেতে হয়। জীবনকে সুন্দর, সফল ও সমৃদ্ধ করতে হলে সংগ্রাম ও সাধনা করতে হয়। এগুলো বাদ দিয়ে সুখ লাভ সম্ভব নয়। 

আমরা যদি আমাদের আকাবির-বড়দের জীবনের প্রতি তাকাই, তাহলে দেখতে পাই তারা তাদের জীবনে বহু দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করেই জীবনে বড় হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হাফেজী হুজুরের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নতুন মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী। যার উস্তাদরা তার ব্যাপারে বলেন, ‘আমি তাকে পড়িয়েছি।’

মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী । ছবি : বাংলাদেশের খবর

জন্ম ও শৈশব 
জীবন্ত কিংবদন্তী আলেম মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী ১৯৬১ ঈসাব্দে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার অন্তর্গত দাদপুর গ্রামে খান বংশের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জনাব আবদুর রশিদ খান এবং মাতার নাম জনাবা আমাতুল্লাহ বানু। শৈশবে মাত্র ১০ বছর বয়সেই বালক ইউসুফ সাদিক তার মাকে হারিয়ে শোকের সাগরে পতিত হন। আশ্রয় নেন নানা-নানির নিকট এবং এখানেই তার শৈশব কাটে। তার নানা ছিলেন দাদপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক জনাব হাজী বাবন মোল্লা (রহ.)।

প্রাথমিক শিক্ষা 
নানা-নানির আশ্রয়ে মামাদের সাথে বাড়িতে পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। যখন একটু বুঝতে শুরু করেন তাকে ভর্তি করানো হয় দাদপুর প্রাইমারি স্কুলে। এখানে পড়ার সময়-ই তার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বিশেষ ঝোঁক পরিলক্ষিত হলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তাকে ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। বিশেষত বর্ষায় কাদা-পানি মাড়িয়ে প্রতিদিন দাদপুর থেকে বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া যে কত কষ্টকর ছিল, তা স্বচক্ষে না দেখলে অনুভব করা প্রায় অসম্ভব। 

এ ছাড়াও নানাবিধ কষ্ট ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এখানে ফজিলত ১ম বর্ষ (জালালাঈন) পর্যন্ত পড়েন। কিন্তু ইলমে দ্বীনের অসীম পিপাসায় কাতর ছাত্র ইউসুফ সাদিক স্থির হতে পারছিলেন না; উচ্চশিক্ষা অর্জনের অদম্য স্পৃহা তাকে রাজধানীতে টেনে নিয়ে আসে। ভর্তি হন অলীকুল শিরোমনি হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্বী হুজুর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায়, ফজিলত দ্বিতীয় বর্ষে (মেশকাত জামাত)। পরের বছর এখানেই দাওরায়ে হাদিস পড়েন। তার সুন্দর পড়াশোনা, মার্জিত আদব-আখলাক হাফেজ্বী হুজুরের নজরে আসে। তারপর থেকে কিশোর ইউসুফ সাদিককে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। দাওরায়ে হাদিসে অধ্যয়নকালেই তিনি হাফেজ্বী হুজুরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারপর তার নির্দেশে আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি দারুল ইফতার কাজে নিয়োজিত হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সমাপ্ত হয়। 

কর্মজীবন 
খানকার সাধনা এবং দারুল ইফতার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা অবস্থায়-ই হজরত হাফেজ্বী হুজর (রহ.)-এর নির্দেশে জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু হয়। এর পাশাপাশি স্বীয় উস্তাদ ও মুর্শিদের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতুল হকের কাজ নিয়ে মেহনত করতে থাকেন এবং মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতঃ খাটি মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থাকেন।

হাফেজ্বী হুজুরের সাথে সফর 
কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি ওয়াজ মাহফিল, খেলাফত আন্দোলনের প্রোগ্রামসহ নানা কারণে তিনি হাফেজ্বী হুজুরের সঙ্গে সারা বাংলার আনাচে কানাচে সফর করেন এবং স্বীয় উস্তাদের তরজুমান (মুখপাত্র) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্বী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ১৯৮৯ ঈসাব্দে ঢাকার সাভারে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া বলিয়ারপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা এবং পরে মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি সাভারের একটি দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস। একই সঙ্গে তিনি বর্তমানে দেশের একাধিক মাদ্রাসার প্রধান মুরুব্বী এবং উস্তাজুল হাদিস হিসেবে ইলমেদ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি হাফেজ্বী হুজুর (রহ.)-এর অর্পিত দায়িত্ব পালনার্থে কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসার অদূরে অবস্থিত মাদবারবাজারের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদে সুদীর্ঘ ৩৭ বছর যাবত খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি একজন প্রখ্যাত বক্তাও। 

আধ্যাত্মিক সাধনা 
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম এবং আউলিয়াদের প্রত্যেকেই আধ্যাত্মিক সাধনা এবং কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা খোদাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে থাকেন। এ পথে সফলতা অর্জনের একমাত্র উপায় কঠোর সাধনা ও রিয়াজাত তথা আত্মবিনাশন। যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তারাই সফলতা পান। মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানীও তেমন-ই একজন। হাফেজী হুজুর (রহ.)-এর সোহবতে থেকে মেহনত-মুজাহাদার সবক বেশ ভালভাবে রপ্ত করেছেন তিনি, আর তিনি এ পথে নিজের গুরু ও মুর্শিদ মানেন হাফেজ্বী হুজুর (রহ.)-কে। হাফেজ্বী হুজুরের ইন্তেকালের পর বাংলার বিশিষ্ট বুযুর্গ আলেম হজরত আল্লামা নুরুল হক আজমী (রহ.) তাকে খেলাফত ও এজাজত দান করেন। উম্মতের মুসলিমার ইসলাহের ফিকির নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকেন তিনি এবং এ লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরও করেন। 

খেলাফত প্রদান 
তিনিও বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ও বুযুর্গ আলেমকে খেলাফত প্রদান করেছেন। তার খলিফাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- মাওলানা মাহমুদুল হাসান ভৈরবী, মাওলানা হাফেজ আবদুল জলিল নাটোর, মাওলানা মুফতী মতিউর রহমান ঈশ্বরদী ও মাওলানা খলিলুর রহমান রাজবাড়ী। 

যাদের নিকট পড়েছেন 
ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়া মাদ্রাসা এবং কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় পড়ার কারণে মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী দেশের বড় বড় আলেমদের কাছে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকজন উস্তাদ হলেন- হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজী হুজুর, শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, হজরত আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী, আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ সন্দিপী (রহ.), জামিয়া ইসলামিয়া বাহিরদিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম এবং জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়া মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম হজরত মাওলানা আশরাফ আলী, হজরত মাওলানা সুলাইমান নদভী, হজরত মাওলানা আকরাম আলী, হজরত মাওলানা আব্দুল হক মোমেনশাহী এবং হজরত মাওলানা শেখ আজিম উদ্দিন গোপালগঞ্জী (দা.বা.)। 

সৃষ্টির সেবা 
হাফেজ্বী হুজুর থেকে ইলম-আমল, তাসাউফ শেখার পাশাপাশি খেদমতে খালক বা সৃষ্টির সেবা করার মানসিকতাও রপ্ত করেছেন হযরত মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী। সে লক্ষ্যে তার চাচাজান শহীদ মাওলানা সাদিকুর রহমানের নামে ‘শহীদ এম সাদিকুর রহমান ইলমি ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের এতিম দুঃখী বিধবা অসহায় এবং গরীব মানুষের যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এবং একইসাথে ‘মারকাযুত তালিম ওয়াত তাযকিয়াহ’ নামক একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে তিনি উম্মতে মুসলিমার ইসলাহের ফিকির করে যাচ্ছেন। 

দাদপুর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা 
নিজ গ্রাম দাদপুরে ‘দাদপুর এশআতুল উলূম সাদেকিয়া মাদ্রাসা’ নামে একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। একযুগের বেশি সময় ধরে মাদ্রাসাটি এলাকার শিশুদের প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষায় বেশ অবদান রেখেছে। বর্তমানে হজরত মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানীর বড় পুত্র মাওলানা সিফাতুল্লাহ মাদ্রাসাটি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। সভাপতির দায়েত্বে আছেন গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুরব্বী জনাব হাজী চুন্নু মোল্যা। 

রাজনীতি 
হাফেজ্বী হুজুরের মতো দ্বীনের প্রায় প্রতিটি শাখায়-ই তার অবাধ বিচরণ। তওবার রাজনীতির স্বাক্ষী তিনি। সে হিসেবে তার মানসেও ইসলামী রাজনীতি বিদ্যমান। ১৯৮১ ঈসাব্দে ছাত্র থাকাকালীন হজরত হাফেজ্বী হুজুরের নির্বাচনে একজন ত্যাগী কর্মী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তার ওপর খেলাফত আন্দোলনের বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পিত হয়। আর সদ্যই তিনি হাফেজ্বী হুজুর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ দলটির মহাসচিবের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন এবং জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য। 

রচনাবলী 
লেখালেখির জগতেও তার উপস্থিতি প্রশংসনীয়। একজন সফল লেখক হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি সর্বমোট ১৮টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সেবার ছদ্মাবরণে খ্রিস্টান বানানোর অপচেষ্টা, নতুন নামে পুরাতন অতিথির আগমন, সন্ত্রাস মূলোৎপাঠনে ইসলামের ভূমিকা, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ও দাজ্জালী সন্ত্রাস, প্রিয় নবীজির নামাজ, নবীর দেশের মেহমান, হযরত হাফেজ্বী হুজুরের সাথে পথ থেকে পথে, দেওয়ানে হক্কানী, মারেফাতে হক্কানী, বাংলার জমিনে দাওয়াত ও তাবলীগের ইতিহাস এবং মাওয়ায়েজে হাফেজ্বী হুজুর (রহ.)। 

পারিবারিক জীবন
তিনি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যাকে বিয়ে করেন। তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে মহান রাব্বুল আলামীন চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান দান করেছেন। তার সন্তানরা সবাই আলেম। কন্যাদের বিয়েও দিয়েছেন আলেমের সঙ্গে। 

বর্তমান অবস্থা 
মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানীর বয়স এখন প্রায় ৭০। এই বয়সেও তারুণ্যের মতো বিরামহীনভাবে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। আমরা আল্লাহর নিকট দোয়া করি- এই মহান পুরুষের দ্বারা উম্মাহ আরও উপকৃত হোক এবং তার ছায়াকে আমাদের ওপর দীর্ঘ করেন। আমীন।

-বেলায়েত হুসাইন রচিত ও মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী সম্পাদিত ‘ফরিদপুর জেলার বরেণ্য আলেম ও প্রসিদ্ধ কওমী মাদ্রাসা’ গ্রন্থ অবলম্বনে

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর