Logo

রাজনীতি

শরিকদের সঙ্গে বৈঠক বিএনপির

যুগপৎ আন্দোলনের সুর

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫০

যুগপৎ আন্দোলনের সুর

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে নানা শঙ্কায় বিএনপি। কয়েকটি কারণে এ নির্বাচন ঘোষিত সময়ে হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে দলটির মধ্যে। দলের নেতারা মনে করছেন, সরকারের ভিতরেই একটি মহল নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো পরিষ্কার পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি।

এমনকি নির্বাচন আয়োজনের আগে যে প্রস্তুতিগুলো নেওয়ার কথা, সেগুলোর কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিজেদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে এ বৈঠক করছে বিএনপি।

যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সরকারপ্রধানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় কী ফলাফল এসেছে, বিএনপি মূলত সেটি জানানোর জন্যই শরিকদের সঙ্গে বসেছে। নির্বাচন এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে তাদের মতামত নিচ্ছে, যা পরে নিজস্ব ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। 

তবে মিত্ররা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে রাজি নয়। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চান। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীরা মনে করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেবে। এ সরকারের বৈধতা তারাই দিয়েছেন। এখন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে। তাই এখনই তারা সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে একমত নন।

যদিও অন্তর্বর্তী  সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে একটি সেরা নির্বাচন আয়োজন করা হবে। তবে বিএনপি বলছে- শুধু কথায় কাজ হবে না।

প্রসঙ্গত, সামাজিক মাধ্যমে গত কিছুদিন ধরে একটি প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে অধ্যাপক ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখা হোক। বিএনপি মনে করছে, এই প্রচারণার সঙ্গে সরকারঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

তারা এটিকে ১/১১র মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি বিরাজনীতিকরণের পরিকল্পনা হিসেবে দেখছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিএনপি বিভিন্ন সমমনা দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে।

অন্যদিকে, বিএনপির পুরোনো রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর আমির সম্প্রতি লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরে ঢাকায় ফিরে তিনি বলেছেন, জরুরি সংস্কারের পর আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত।

এদিকে শনিবার দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠক করেছেন বিএনপি ও এলডিপির নেতারা। এতে ডিসেম্বরের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে বলে প্রত্যাশা করছেন দল দুটির নেতারা।  

বৈঠক শেষে এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো রাজনৈতিক সংস্কার হয়নি। সরকার একবার এক কথা বলে, আবার পাল্টে ফেলে। আমরা অনুরোধ করছি, যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া হোক।

আর বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের জন্য এখনই আন্দোলনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। আমরা আশা করি, সরকার জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবে। 

এ ছাড়া গতকাল রোববার সিপিবি, বাসদসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে চা-চক্রে মিলিত হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে সর্বদলীয় ঐকমত্য গঠন করতে চায় বিএনপি। 

এ বিষয়ে ১২ দলীয় জোটের একজন নেতার ভাষ্য- বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কাট অফ লাইন চায়। তারা এ বিষয়ে জনমত ও দলমত গঠন করতে চায়। এজন্য সব দলের সঙ্গে বসতে চায়। ডান, বাম, প্রগতিশীল, ইসলামী দল- সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বদলীয় মত তৈরি করতে চায়।

আরেক নেতা বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বিগত ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, ২৪-এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, এমন দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। 

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের মাথায় আন্দোলনের কোনো শব্দ নেই। আমরা জনমতের বাইরে যেতে চাই না। বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে একমত হয়েছি। আর তা আদায়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কথা হয়েছে। এ লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে কিছু সভা সমাবেশ করে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হবে।

তিনি বলেন, কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন জরুরি, তার বাস্তবিক দিক জনগণের কাছে তুলে ধরা হবে। জানুয়ারিতে রমজান কাছাকাছি চলে আসবে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ চলে যাবে রোজা ও  ঈদের মধ্যে। এপ্রিল থেকে কালবৈশাখী, পরে বর্ষা বাদলা শুরু হয়ে যাবে। বাংলাদেশে এই সময়ে নির্বাচন সম্ভব নয়। 

তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান শক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে ভারতবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে ‘ইউনূস ৫ বছর থাকুক’-এমন যে প্রচারণা সামাজিক মাধ্যমে চলছে তার পাল্টা জবাব দিতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সক্রিয় করার কথা ভাবা হচ্ছে।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নির্বাচন নিয়ে কর্মসূচির দিকে গেলে অন্য একটি পক্ষ ‘এ মুহূর্তে নির্বাচন নয়’ বলে প্রকাশ্যে এলে পরিস্থিতি অযথা জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গ্রেটার ঐক্য গড়ে তুলতে চায় বিএনপি। তবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ কয়েকটি ইসলামি দল নির্বাচন প্রশ্নে ‘ডিসেম্বরের মধ্যে থাকতে চায় না’। প্রকাশ্যে এসব দল সংস্কার করার ও আওয়ামী লীগের বিচার শুরু করার পর নির্বাচনের দাবি তুলছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থার সংকট দেখা দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এক্ষেত্রে তার ওপর আস্থার রাখার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়ে শক্ত ভূমিকা প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটিও গুরুত্বপূর্ণ।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল মনে করেন, বিএনপি বেশি চাপাচাপি করলে সরকার দেশি-বিদেশি ‘ট্র্যাপে’ পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সুবিধা পাবে জামায়াত। নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হলে পরিস্থিতি ভয়ানক পরিণতি ধারণ করতে পারে, এমন সতর্কতাও বিএনপির থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারাই রাজপথে ছিলেন আমরা সবার সঙ্গে কী করা যায়- তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। এই আলোচনা শেষে আমরা ভাববো যে, কী করা যায় বা কী করা যায় না। তবে, আমরা মনে করি না যে, তেমন কিছু দরকার হবে।

তিনি বলেন, কারণ এই সরকারে যারা আছে, আমরাই এই সরকারকে বসিয়েছি, এই প্রত্যাশায় যে, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তারা ভূমিকা পালন করবেন। এখনো এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি, সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করবে।

বিকেপি/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর