
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন এবং দলটির সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশের মানুষ। শুধু ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থানেই প্রায় দুই হাজার শহীদ ও হাজারো মানুষ আহত হন। এরপর পালিয়ে যেতে বাধ্য হন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তখন থেকেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি উঠে। অন্তর্বর্তী সরকার বরাবরই বলে আসছে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করবে সরকার। কিন্তু সরকার নিজ থেকে উদ্যোগ নেবে না।
তবে এবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতাসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। বৃহস্পতিবার রাত থেকে চলছে জোরালো আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা দেখেই ঘরে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে। এতে সরকার রয়েছে বেকায়দায়। সরকার এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, যে কোনো সময় আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এটা শিগগিরই হবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার’ উদ্যোগ নিয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশ ত্যাগের খবর নিয়ে আলোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাত থেকে সরকারপ্রধানের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নিয়েছেন এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ নেতৃত্বাধীন একদল বিক্ষোভকারী।
তাতে সংহতি প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
গতকাল জুমার পর সেখানে ‘বড় জমায়েতের’ আয়োজন হয়েছে। এরই মধ্যে দুপুরের পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে বিবৃতি দেওয়া হলো।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে।’
এ বিষয়ে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার ‘জনদাবির’ প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রচলিত আইনের অধীনে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশ ত্যাগের বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভের বিষয়ে সরকার অবগত। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর।’
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তখন জোরালো হয়।
সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের আলোচনাও চলে প্রায় এক যুগ ধরে। সে জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও আওয়ামী লীগ সরকার সে কাজ আর শেষ করেনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনা করে সেই ট্রাইব্যুনালে এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগ আইনে যে সংশোধনী করেনি, সেই সংশোধনী এনেই এখন ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের বিচার হতে পারে।
ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগে নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ।
১ আগস্টের সেই নির্বাহী আদেশ টেকেনি এক মাসও। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ২৮ আগস্ট ওই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশে ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে টেকসই হবে না মত দিয়ে অনেকেই আইন সংশোধনের তাগিদ দিচ্ছিলেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা বলেছি, এটা জনগণের ব্যাপার, জনগণ যদি চায়। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, যে কোনো রাজনৈতিক দল সেটা নিষিদ্ধ হবে কি হবে না তাতে জনগণের দায়িত্ব রয়েছে। যদি আইন ভঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে বিচার বিভাগ দায়িত্ব নিতে পারে।’
বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে আমি আরেকটা রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধ করার কথা বলি না। জামায়াতে ইসলামীর মতো দলকেও আওয়ামী লীগ যখন নিষিদ্ধ করেছে, আমরা বিরোধিতা করেছি।’
এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে কথা বলতে হবে। আমি দেখতে পারি না, সেজন্য আপনি খারাপ, আপনার উপর সব চাপিয়ে দিলাম, এটা ঠিক নয়। তাহলে কি বিএনপি চায় না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক? ফখরুল বলেন, আমরা কখনই এ কথা বলিনি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। সব রাজনৈতিক দল যদি চায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু প্রক্রিয়াটা কী হবে?
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে এবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করলেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল বিকাল পৌনে ৫টার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছের ফোয়ারার পাশে তৈরি করা মঞ্চ থেকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করার ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে এসে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। সেখানে অবস্থান নিয়ে তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন।
এর আগে জুমার নামাজের পর থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার কাছের ফোয়ারার পাশে মঞ্চ তৈরি করে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। বিকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে মঞ্চ থেকে শাহবাগ অবরোধ করার ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
এ সময় এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের অগ্রগতি সেদিন থেকে শুরু হবে, যেদিন থেকে টাইটেলটা হবে, বাংলাদেশ উইদাউট আওয়ামী লীগ (আওয়ামী লীগহীন বাংলাদেশ)। আমাদের কথা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। তাই এখন আমরা শাহবাগ ব্লকেড করব। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন না আসা পর্যন্ত আমরা শাহবাগে থাকব। এখান থেকে আমাদের দ্বিতীয় অভ্যুত্থান-পর্ব শুরু হবে।’
আওয়ামী লীগের বিচার ও দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থানের ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। পরে রাত ১০টার দিকে যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপির নেতাকর্মীরা হাসনাতের সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন। পরে রাত ১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তাদের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন।
এনসিপির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও রাতে বিক্ষোভে যোগ দেন। রাত ১টার পর হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু নেতাকর্মী যমুনার সামনে যান। রাত দেড়টার দিকে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির কিছু নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত হন। রাত ২টার দিকে সেখানে যান ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা।
রাতভর বিক্ষোভ চলার পর গতকাল সকালে সেখানে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। পরে সেখানে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়। পাঁচটি পিকআপ ভ্যান একত্র করে এই মঞ্চ তৈরি করা হয়।
দুপুর ১২টার দিকে যমুনার সামনে থেকে সরে ফোয়ারার সামনের মঞ্চের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। জুমার নামাজের পর এই মঞ্চের সামনে বড় জমায়েত হয়। এনসিপির পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত ছাত্র মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দলের নেতাকর্মীরা এই কর্মসূচিতে যোগ দেন। দলগুলোর শীর্ষনেতাদের কয়েকজন সেখানে বক্তব্য দেন। পরে হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ অবরোধ করার ঘোষণা দেন।
বিকেপি/ওএফ