Logo

রাজনীতি

৭৬ বছরের ইতিহাসে আ.লীগ যেভাবে নিষেধাজ্ঞা ও নানা সংকটে পড়ে

Icon

ডিজিটাল ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৫, ১৫:০৯

৭৬ বছরের ইতিহাসে আ.লীগ যেভাবে নিষেধাজ্ঞা ও নানা সংকটে পড়ে

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ প্রায় ৭৬ বছরের রাজনৈতিক যাত্রায় একাধিকবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে।

সবশেষ দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে গত ১০ মে রাতে। জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি দল ও সংগঠনের নেতাদের দাবির মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচার করা এবং বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।

তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো এই রাজনৈতিক দলটি এবারই প্রথম এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দলটি এর আগেও কয়েকবার রাজনৈতিক সংকট নাহলে সামরিক শাসনের মুখে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। তবে প্রতিবারই আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হয়ে রাজনীতিতে ফিরে এসেছে।

মোটা দাগে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ বা নিষ্ক্রিয় হওয়ার ইতিহাসকে সাতটি টাইমলাইনে ভাগ করা যায়।

পাকিস্তান আমলে ‘নিষিদ্ধ ঘোষণা’
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ হিসেবে। পরে ১৯৫৫ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’।

প্রতিষ্ঠার এক দশক পেরোনোর আগেই দলটির ওপর প্রথম বড় ধাক্কা আসে ১৯৫৮ সালে, যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়।

আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত, ‘দ্য আওয়ামী লীগ, সেভেন্টি ইয়ার্স আফটার ১৯৪৯’ শীর্ষক নিবন্ধে দলটির ওপর ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের প্রভাব ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। পরে ২৭শে অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পুরোপুরি সেনা শাসনের মাধ্যমে দেশ চালাতে শুরু করেন।

সে সময় সামরিক আইনের অধীনে একটি অধ্যাদেশ (Political Parties Elected Bodies Disqualified Ordinance -PRODO) জারি করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন আইয়ুব খান, যার আওতায় আওয়ামী লীগও পড়ে।

সে সময় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও সভা-সমাবেশ কঠোরভাবে দমন করায় দলটি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলো।

সেইসাথে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তাদের আটক ও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়।

পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত, ‘ফ্রম মার্শাল ল টু ডেমোক্রেসি: পাকিস্তান লং হিস্ট্রি অফ ব্যানিং পলিটিক্যাল পার্টিস’ নিবন্ধে এই নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

তবে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, আওয়ামী লীগ পুনরায় সংগঠিত হয় এবং রাজনীতির মূলধারায় ফিরে আসে বলে জানান রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬২ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যা ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ নামে পরিচিত ছিলো।

এই সংবিধানে পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়, যার ফলে সীমিত পরিসরে হলেও রাজনৈতিক দলগুলো পুনর্গঠনের সুযোগ পায় বলে জানান মি. আহমেদ।

পরে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদসহ তরুণ নেতারা আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে সংগঠিত করেন এবং ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

এই ছয় দফা দাবিকে ঘিরে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দলটি নানাভাবে দমন-পীড়নের মুখে পড়ে।

আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি না হলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ, দলের প্রচার কাজে বাধা দেওয়া হতো এবং নেতাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হতো বলে জানান মি.আহমেদ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে নিষেধাজ্ঞা (১৯৭১)
রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়।

পরদিন, ২৬ মার্চ, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে আওয়ামী লীগকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষণা করে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি রাষ্ট্রদ্রোহী দল এবং এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।’

‘তখন আওয়ামী লীগকে তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক বলে মনে করা হতো যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসক্রিপশনে চলে,’ বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।

এই ঘোষণার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের ‘ইয়াহিয়া ব্যানড আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সেইসাথে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ফ্রম দ্য পাস্ট পেইজেস অব ডন: ১৯৭১, ফিফটি ইয়ার্স এগো, আওয়ামী লীগ আউটলড’ প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়।

তবে এই নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক দমন-পীড়ন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটি আবার সংগঠিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ফিরে আসে।

যুদ্ধ চলাকালীন শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ দলটির সিনিয়র নেতারা ১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠন করেন।

এ সরকার মূলত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারই ছিল। এরপর ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পর আওয়ামী লীগের নেতারা ঢাকায় আসতে শুরু করে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর দ্রুত আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠিত হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংকট ও নিষেধাজ্ঞা (১৯৭৫)
১৯৭৫ সালের ১৫ অাগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। যার ফলে দলটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

এই হত্যাকাণ্ডের পর, একই বছরের নভেম্বরে সেনা সমর্থিত খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়।

তিনি রাষ্ট্রপতির পদে বসার পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সে সময় দলটির অনেক নেতা গ্রেপ্তার বা গৃহবন্দি হন। যার কারণে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে যায় আওয়ামী লীগ।

বাংলাপিডিয়ায় আওয়ামী লীগ শীর্ষক নিবন্ধে দলটির ইতিহাস ও ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিস্তারিতভাবে জানা যায়।

এছাড়া লরেন্স লিফটশুলজের, ‘বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভোলিউশন’ বইয়ে উল্লেখ আছে, সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ না করলেও তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলো এবং তাদের নেতাদের ওপর নজরদারি করা হতো।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আওয়ামী লীগের চার শীর্ষ নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি বড় শূন্যতা সৃষ্টি করেছিলো। যা দলের সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই দুর্বল করে দেয়।

এক কথায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নামমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে।

এরপর ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকার পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন করতে বলে। সে সময় আওয়ামী লীগ নতুন করে নিবন্ধন নিয়ে রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান হতে শুরু করে বলে জানান রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

তবে দলটি পূর্ণাঙ্গভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনার হাত ধরে।

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসে।

তিনি বিদেশে থাকাকালীন ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৮২ সালের এরশাদ–সমর্থিত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত ছিল।

এরশাদ শাসনামলে নিষেধাজ্ঞা (১৯৮২–১৯৯০)
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদ সরকার আওয়ামী লীগকে সরাসরি নিষিদ্ধ না করলেও, দলটি নানা ধরনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, নিষেধাজ্ঞা ও দমনমূলক পদক্ষেপের মুখোমুখি হয়।

রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এরশাদের সময়ে শুধুমাত্র ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দেয়া হতো। মানে রাজনৈতিক নেতারা তাদের ঘরে বসে মিটিং করতে পারবেন। কিন্তু কোন জনসভা, মিছিল করতে পারবেন না।’

গ্লোবাল ননভায়োলেন্ট অ্যাকশন ডাটাবেসে প্রকাশিত, ‘বাংলাদেশ ব্রিং ডাউন এরশাদ রেজিম, ১৯৮৭-১৯৯০’ নিবন্ধে এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সেখান থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন।

এসময় সংবিধান স্থগিত করে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।

ফলে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে দলটি গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, হরতাল এবং পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দেওয়ায় শেখ হাসিনাকে ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ সালের মধ্যে চার দফা গৃহবন্দি করা হয়েছিলো।

পরে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে এরশাদ ১৯৮৬ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং নির্বাচনের ঘোষণা দেন।

ওই বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আবারও সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।

পরের বছর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যৌথভাবে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সময় সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে, সংসদ ভেঙে দেয় এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে।

১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাপক গণআন্দোলনের ফলে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আওয়ামী লীগ পুনরায় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বিএনপি-জামায়াতের আমলে নিপীড়ন (২০০১-২০০৬)
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ এবং এর সমর্থকদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক সহিংসতা চালানো হয়েছিলো বলে জানান রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

তিনি জানান, নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয়ের পর থেকেই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা শুরু হয়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক, ভোটার ও সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, দোকান, জমিজমা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া যায়। সেইসাথে অনেক স্থানে নারী নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের ঘটনাও খবরের শিরোনাম হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে বাধা, নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি করা হতো বলে জানান রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

অনেক জেলায় দলীয় কার্যালয়ে এবং নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা চালানোয় দলীয় নেতাকর্মীরা এলাকা ছাড়তেও বাধ্য হন।

সেসময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে উদ্বেগ জানায়।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে (২০০৭-২০০৮) সংকট
২০০৬ সালের শেষ দিকে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। যার ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে।

‘ক্রাইসিস গ্রুপ: বিয়ন্ড ইলেকশন: ওভারকামিং বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ডেডলক’ শীর্ষক বিশ্লেষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দমন-পীড়নের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘বাংলাদেশ: ইভেন্টস অফ ২০০৭’ প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ২০০৭–২০০৮ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সরাসরি নিষিদ্ধ না হলেও, দলটি দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, এবং দলীয় কার্যক্রমে বিধিনিষেধের মুখোমুখি হয়।

এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং একাধিক দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করা হয় বলে জানান রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মাইনাস টু’ নীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ।

জুলাই আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিষেধাজ্ঞা (২০২৫)
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সমমনা দল ও সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষেধাজ্ঞার দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছে।

সবশেষ আওয়ামী লীগ আমলে দুইবারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৮ মে রাত থেকে আন্দোলন শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সহ কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

সেখানে এনসিপির পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবির, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ) ও জুলাই আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।

৯ মে পর্যন্ত উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এবং মিন্টো রোডের মোড়ে ফোয়ারার সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও সমাবেশ করে। ১০ মে তারা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেন।

চলমান আন্দোলনের মুখে ১০ মে রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বৈঠকে বসে উপদেষ্টা পরিষদ।

বৈঠক শেষে ঘোষণা করা হয় যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব ধরনের কার্যক্রম (সাইবার স্পেসসহ) নিষিদ্ধ থাকবে।

আওয়ামী লীগ তাদের ইতিহাসে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা ও সংকটে পড়েও রাজনীতির মূলধারায় ফিরে এসেছে।

তবে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে দলটির ভবিষ্যৎ কৌশল কোন দিকে যাবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তথ্যসূত্র-বিবিসি বাংলা 

এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর