বিএনপিতেই আশ্রয় খুঁজছে আ.লীগ
-682d48c95b1a3.jpg)
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক এবং অবস্থান নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। ক্ষমতা হারানোর পর নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছেন।
তাদের অনেকের জন্য বিএনপিই এখন একমাত্র সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে। চট্টগ্রামে বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি মন্তব্য করেন, 'আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসররা বিএনপিতে স্থান পাবেন না। তবে যারা সমাজে গ্রহণযোগ্য, কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা কিংবা বিএনপিবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না, তাদের জন্য দরজা খোলা।'
তিনি আরও জানান, সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকবে। চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ বা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিএনপিতে নেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের করুণ পরিণতি: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বড় অংশ এখন জেলে বা আত্মগোপনে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। এরপর ১২ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে।
ফলে নেতাকর্মীরা রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে যারা ‘ক্লিন ইমেজ’-এর আওতায় পড়েন, তারা বিএনপিকে একটি সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাবছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্য ও অবস্থান আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর জন্য ‘রাজনৈতিক পুনর্জন্ম’- এর সুযোগ এনে দিতে পারে।
বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন এবং সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্যতা
বিএনপি তার রাজনৈতিক দর্শনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেয়। মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচি এখনো দলের রূপরেখায় প্রভাব ফেলে। বিএনপির মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এই জাতির পরিচয়ের ভিত্তি, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে পৃথক।
এই আদর্শের আলোকে বিএনপি এমন নেতাদের গ্রহণ করতে রাজি; যারা অতীতে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন কিন্তু দলের দমন-পীড়নে অংশ নেননি। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে এবং ‘মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে’ গ্রহণযোগ্য লোকদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
অন্য রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও সীমাবদ্ধতা
আওয়ামী লীগের জন্য অন্য যেসব দল হতে পারত সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল, তাদের অবস্থাও এখন নাজুক। জামায়াতে ইসলামী কিংবা এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) উভয় দলই আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী অবস্থানে।
জামায়াতের সঙ্গে আদর্শগত দূরত্ব এবং এনসিপির সঙ্গে অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট বিরোধ আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য সেখানে স্থান পাওয়া কঠিন করে তোলে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকরাও তাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত। এই দলগুলোতে আওয়ামী লীগের বিশাল সংখ্যক নেতাকর্মী সঞ্চারিত হলে বরং দলগুলোতে ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা থাকে।
বিএনপির অবস্থান ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা
বিএনপি এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। বরং দলটি বলেছে, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করবে কি না, সেটা জনগণের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ধরনের অবস্থান আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর জন্য স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছিল। তারা আশা করেছিলেন, ভবিষ্যতে বিএনপির কর্মসূচির ছায়ায় মাঠে ফেরার সুযোগ মিলতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা ও নির্বাচন কমিশুদের সিদ্ধান্ত সেই আশা কার্যত বিনষ্ট করেছে।
আইনি ঝামেলা ও দমন-পীড়নের ভয়াবহতা
ক্ষমতা হারানোর পর থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের নামে প্রচুর মামলা দায়ের হয়েছে। শেখ হাসিনার নামে আড়াই শতাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্ক, মামলা ও হামলার ভয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। এই চাপমুক্তি ও আত্মরক্ষার জন্য অনেকে বিএনপিতে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, যারা দমন-পীড়নের সঙ্গে জড়িত নন, তারা রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যারা স্বৈরাচারী আচরণ করেননি, তারা চাইলে বিএনপিতে আসতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি- রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে।’
সার্বিক বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিণতি যতই করুণ হোক না কেন, তাদের অনেক নেতাকর্মীর জন্য বিএনপি হতে পারে একটি নতুন আশ্রয়স্থল। দলীয় পরিচয়ের পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক সক্রিয়তা রক্ষা করতে চাওয়া এসব নেতাকর্মীর পুনরুদ্ধার সম্ভব; যদি তারা অতীত অন্যায় থেকে মুক্ত থাকেন এবং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ তার কৃতকর্মের জন্য এ নিয়ে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এই দল টানা ১৭ বছর দেশ পরিচালনা করে এক ধরনের অন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
আওয়ামী লীগের বাইরে ভিন্ন মতাদর্শের জনগণকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সুতরাং যারা এখনো দেশে গা-ঢাকা দিয়ে আছে, তারা যদি দেশের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্তত যারা ফ্যাসিস্ট আচরণকে সমর্থন করেনি।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আমিনুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ ইতিহাসের প্রাচীন দল হলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা চরম নির্যাতন চালিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের একটি সমর্থন রয়েছে, যা ধরে রাখতে চাইলে 'ভুল পথে না গিয়ে' যারা নির্যাতন থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন, তারা রাজনীতিতে ফিরতে পারেন।
এ পরিস্থিতিতে অনেকেই টিকে থাকা এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিএনপির দিকে ঝোঁকার চেষ্টা করবেন। আর বিএনপি সেই সুযোগ দিলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বিএনপিতে ঢুকে পড়বেন। এভাবে বিএনপিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে আওয়ামী লীগ।