-682e9e7f6e65d.jpg)
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এক সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা বিএনপি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন মুখোমুখি অবস্থানে। তাদের মধ্যে তীব্র কথার লড়াই দেশের রাজনীতিতে বাড়তি উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে সহযোদ্ধা হওয়া দুদলের মধ্যে এই বিরোধ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সাধারণ মানুষ এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, এটি আসলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। বিএনপি ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে এনসিপি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিতে চেষ্টা করছে।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণ নিয়ে জটিলতা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আইনি জটিলতার কথা উল্লেখ করে ইশরাকের শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ইশরাক শপথ নিতে অনড় এবং বিএনপি প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। উপদেষ্টা আসিফের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
নির্বাচন বনাম সংস্কার, দুই দলের ভিন্ন মত
বিএনপি যখন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, তখন এনসিপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর, বিএনপি এবং তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। শুরুর দিকে তারা একাধিক প্ল্যাটফরমে একই সুরে কথা বললেও নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপির সরব হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
পরবর্তীতে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠিত হলে তারা বিএনপির নির্বাচনের দাবির কড়া বিরোধিতা শুরু করে। এনসিপি দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে এবং জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচনেরও দাবি করছে। একই সঙ্গে তারা গণপরিষদের মাধ্যমে ‘নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল করার পরিবর্তে, এনসিপি মূলত নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে এবং এতে সরকারের মদদ আছে বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, এনসিপি নেতারা বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, এক দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানো গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, একটি দলকে ক্ষমতায় বসাতে নির্বাচন চাপিয়ে দিলে তা মেনে নেওয়া হবে না।
বাগযুদ্ধ এবং ইশরাকের শপথ সংকট
ক্রমেই দুই দলের নেতারা নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ ইশরাকের শপথ গ্রহণের ইস্যু এই বাগযুদ্ধকে আরও প্রকট আকার ধারণ করিয়েছে। ইশরাকের অনুসারীদের টানা বিক্ষোভের মাঝে, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ১০ ধরনের বাধার কথা তুলে ধরেন। সোমবার উপদেষ্টার আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরার পর, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন এর পাল্টা জবাব দেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের তীব্র সমালোচনা করে শপথ নেওয়ার বিষয়ে তার অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।
শুধু ইশরাকই নন, বিএনপির শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরাও উপদেষ্টা আসিফ এবং এনসিপি নেতাদের জড়িয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলছেন। এর পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে, এনসিপির শীর্ষ নেতা আব্দুল হান্নান, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমরা জুলাই অভ্যুত্থানের ভূমিকার কথা তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এমনকি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা এসব ছাত্রদের ভূমিকার কথা বলে আইন উপদেষ্টাও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত ২৬ মার্চ সাভার স্মৃতিসৌধে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানানোর পর বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সংস্কার ও বিচার ছাড়াই নির্বাচনকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পুনর্বাসনের জন্য নানা ধরনের পাঁয়তারা চলছে।’ এর জবাবে, এনসিপির দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যখন শুনি আগে সংস্কার পরে নির্বাচন- এ যেন শেখ হাসিনার সে কথারই প্রতিধ্বনি, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র।’
সর্বশেষ মঙ্গলবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু হয়েছে। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের সজাগ থেকে এসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখে দেওয়ার আহ্বান জানান।
আক্রমণাত্মক মন্তব্য, সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
ইশরাক অনুসারীদের আন্দোলন নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সোমবার বলেছেন, ‘গায়ের জোরে নগর ভবন বন্ধ করে বিএনপি আন্দোলন করছে। ইশরাকের শপথ নিয়ে জটিলতা নিরসন না করা পর্যন্ত শপথ গ্রহণ সম্ভব নয়।' আসিফের সুরে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। ইশরাকের উদ্দেশে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, 'যে নির্বাচন অবৈধ, সেই নির্বাচনের মেয়র আমি কীভাবে হতে চাই? সেটা কীভাবে বৈধ হয়? তাহলে তো সেই নির্বাচনকে আমি বৈধতা দিয়ে দিচ্ছি।’
এরপরই পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। সরকারে থাকা কতিপয় ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে ইশরাক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘মেয়র-ফেওর কিছু না। অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় ব্যক্তির অন্তরে ক্ষমতার লোভ ও এটি চিরস্থায়ী করার কুৎসিত সত্যটা বের করে আনাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘সর্বশক্তি দিয়ে এরা ঢাকায় বিএনপির মেয়র আটকানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী ভূমিকা পালন করবে, তা ক্লিনকাট বুঝিয়ে দিল।’ ইশরাক অবিলম্বে নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে একটি দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
এ কথার রেশ কাটতে না কাটতেই, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিএনপি চলে— এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাষায় বলেন, ‘বিএনপি নেতারা যদি একত্রে প্রস্রাব করে দেন তাহলে এই প্রস্রাবের তোড়ে ভেসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়বা। এমন কোনো কথা বলবা না যে কথার দায়িত্ব নিতে পারবা না।’
এর জবাব দিতে গিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘এত কিছু না করে বিগত ১৬ বছরে দুদু ভাই একটা গণপ্রস্রাব কর্মসূচির ডাক দিলেই পারতেন!’ একই দিন ঢাকায় দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় সারজিস ফের পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘ঢাকায় মুষলধারে যেটা হচ্ছে সেটা বৃষ্টি নাকি দুদু ভাইয়ের দেওয়া কর্মসূচি?’ এর আগে কুমিল্লায় দেওয়া হাসনাতের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে সাত দিনের আলটিমেটাম দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতার পূর্বাভাস
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ইশরাক ভার্সেস আসিফ। বিএনপি ভার্সেস এনসিপি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যারা জিতবেন তারাই আগামীতে টিকবেন। যারা হারবেন তাদের ভোগ করতে হবে ঐতিহাসিক দুর্ভোগ, দুর্দশা, অপমান আর গ্লানি।’
এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা বলা কঠিন। তবে এটা স্পষ্ট, এ মুহূর্তে দুই দলের মধ্যে বিদ্যমান এই সংঘাত দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।