Logo

রাজনীতি

ডিসেম্বরেই নির্বাচন দাবি বিএনপির, অন্যরা কী বলছে

Icon

ডিজিটাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ২১:৩৩

ডিসেম্বরেই নির্বাচন দাবি বিএনপির, অন্যরা কী বলছে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরব বিএনপি /ছবি : সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরব বিএনপি। এর আগে দলটির একাধিক নেতা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও, এবার সেই দাবি বেশ জোরালোভাবে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

নির্বাচন নিয়ে ‘টালবাহানা’ চলছে উল্লেখ করে ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির তারুণ্যের সমাবেশে তারেক রহমান এসব কথা বলেন। বিএনপির এই অবস্থান নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোনো কোনো দল বলছে, নয়মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখাতে পারেনি। বরং দেশের মধ্যে বেড়েছে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা। ফলে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে যৌক্তিক বলছে তারা।

আবার নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে এনসিপিসহ ইসলামপন্থি কিছু দল। যার কারণে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির শক্ত অবস্থানকে ‘সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির চাপের মুখেই গত বছরের ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেন।

কিছুদিন আগে তার কথিত পদত্যাগ ভাবনার বিষয়ে আলাপ শুরু হলে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধ্যাপক ইউনূসের সাথে দেখা করেন। তখন প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আবারও জানান যে, জুন মাসই হবে এই সরকারের ‘কাট অফ টাইম’।

তবে নির্বাচনের এই সময়সীমা নিয়ে কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না বিএনপি। সবশেষ বুধবার দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবারও দলটির জোরালো অবস্থান জানান দেন।

এনিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, যেকোনো গণতান্ত্রিক শক্তি বা দল নির্বাচনের দাবি করতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে সংস্কারের রোডম্যাপ এবং বিচারকে দৃশ্যমান করা গুরুত্বপূর্ণ।

দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘সংস্কার ফেলে রেখে শুধু নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে চাওয়াটা বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু না, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে, সেটার জন্যে একটা ক্রাইসিস তৈরি করতে পারে।’

তার মতে, জুলাই সনদের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হলে এবং তা বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলে সংকট কাটানো সম্ভব।

নির্বাচনের আগে সংস্কারের কথা বলছে অন্য ইসলামপন্থি দলগুলোও।

ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের যে কথা বিএনপি বলেছে, তার সমালোচনা করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘ওনারাই যদি নির্বাচন ঘোষণা করে দেন, তাহলে বাকি কাজটাও ওনারা করুক’।

তিনি বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অনেক দায়িত্ব গুছিয়ে করতে না পারলেও অন্তত উদ্যোগ নিয়েছেন।

আর বড় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিৎ ছিল সরকারকে সহযোগিতা করা। উল্টো রাস্তায় সমাবেশ করে আল্টিমেটাম দেওয়াটা আসলে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল, যা ইসলামী আন্দোলন খুব ভালোভাবে দেখছে না বলে মন্তব্য করেন গাজী আতাউর রহমান।

এছাড়াও বিএনপি যদি নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে, তবে দলটির সহযোগিরাও তাদের ভাষায় কথা বলবে, যেটা দেশের জন্য ভালো হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

তবে সরকার ঘোষিত সময়ে নির্বাচন না করলে ইসলামী আন্দোলনও শক্ত অবস্থানে যাবে বলে জানান দলটির মুখপাত্র।

অন্যদিকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ‘অন্তত ফেব্রুয়ারি, মার্চ নাগাদ’ নির্বাচন হওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক।

তিনি বলছেন, বিএনপি যে সময়ে নির্বাচন চাইছে আর প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা দিয়েছেন তার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। সেক্ষেত্রে ‘প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট একটি মাসের ঘোষণা দিতে পারেন।

এছাড়াও নির্বাচনের সঙ্গে যদি বিএনপি বিচার ও সংস্কারকেও তার দাবির মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করে তবে তারা অন্য দলগুলোর সমর্থন পাবে বলেও মনে করেন তিনি।

তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, একেক দল তার তার মতো, স্ব স্ব অবস্থান থেকে তার যেটা ভালো মনে হয় বলবে।

ডিসেম্বর থেকে জুনের যে সময়সীমার কথা সরকার বলছে, তারমধ্যে রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে বা রোজার পরে এপ্রিলে সুবিধামতো সময়ে নির্বাচন চাইছে দলটি।

এনসিপি ও ইসলামপন্থি বাদে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য বিএনপির এই অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে।

বিশেষ করে গত ৯ মাসে সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এবং বাড়তে থাকা রাজনৈতিক বিভাজন ও মতানৈক্যের প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।

তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা করেছি যে, নির্বাচনের একটা সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ ঘোষণা করা দরকার। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ কিংবা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।

নুর বলেন, কিন্তু এরচেয়ে বেশি দেরি করলে বৃষ্টি-বাদলার মতো প্রাকৃতিক কারণেই নির্বাচন পিছিয়ে সরকার ঘোষিত নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ায় শঙ্কা আছে। এছাড়াও সংস্কার প্রশ্নে দলগুলো একমত হলেও কার্যত কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান না হওয়ায় এক ধরনের হতাশাও আছে। সরকারও দেয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। যার ফলে বিএনপি একটা বড় দায়িত্বশীল দল, তারা মনে করছে এভাবে সবকিছুকে অস্পষ্টতার মধ্যে রেখে, সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।

তিনি বলেন, সেখান থেকে আমি মনে করি বিএনপি ঠিক বলেছে। সরকারের এটা আমলে নেয়া উচিত।

অনেকটা একই মত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের। তিনি বলছেন, ডিসেম্বরতো বটেই তার আগেও নির্বাচন করা সম্ভব।

তার মতে, এই সরকার নির্বাচন জুনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারছে না। ফলে তা অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণের ধারণা তৈরি করছে। নির্বাচন শুধু বিএনপির দাবি না বরং জনগণের দাবি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৬ বছর ধরে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষা করছে।

একইসাথে দেশের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনের সূচি ঘোষণার পর তাতেও লাগাম আসবে বলে মন্তব্য করেন এই রাজনীতিবিদ।

সাইফুল হক বলেন, নির্বাচনের শিডিউল ডিক্লেয়ার হলে, নির্বাচনের কাজে গতি আসবে। নির্বাচনমুখী তৎপরতায় সবাই যুক্ত হবে। দেশের বিদ্যমান যে অস্থিরতা, আধা নৈরাজ্যিক যে অবস্থাটা চলছে তারও খানিকটা অবসান হবে।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায় নাগরিক ঐক্যও। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এখনই কোনো জোরালো সিদ্ধান্তে যেতে চাইছে না দলটি।

দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ডিসেম্বর আর জুনের জেদাজেদির মধ্যে যেতে চাই না। আমরা মনে করি ডিসেম্বরে ভোট করা যায়, সরকার চাইলে (নির্বাচন) করতে পারে আর সেটা যুক্তিসংগতও হবে। কিন্তু এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ঝুঁকির কথা ভেবে আমরা হয়তো পড়ে সিদ্ধান্ত নেব।

আর সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যে প্রত্যাশা ছিল ‘নয় মাসের পারফর্ম্যান্সে’ তা আর নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সময় দীর্ঘায়িত করলেও বেশি কিছু হবে, এমন মনে হচ্ছে না।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যদি দৃঢ় অবস্থানে চলে যায়, আর সরকারও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করে তবে দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে বলেই মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।

মান্না বলেন, সংকট তৈরি হবে কিনা তা নির্ভর করবে সব পক্ষের আচরণের ওপর। কেউই যদি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে- ওই রিস্কটা আছে, কোনো সন্দেহ নেই।

আর সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের লড়াইয়ের পর সবার সমর্থনে ও ঐকমত্যে নতুন যে সরকারকে বসানো হয়েছে, তাদের সামনেও যদি আবার আন্দোলন করতে হয়, সেটা আমাদের জন্যে বিব্রতকর, সরকারের জন্যেও বিব্রতকর হবে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে এনসিপির বিষয়টিও টেনেছেন একাধিক রাজনীতিবিদ। তারা বলছেন, নতুন দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্যেই সরকার নির্বাচনের স্পষ্ট সময়সীমা জানাচ্ছে না।

এনিয়ে সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায় কারা? আমি যদি সুনির্দিষ্ট করে বলি, যারা এসরকারের সুবিধাভোগী, যারা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে, অর্থনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে - প্রশাসনিক সুবিধা নিচ্ছে তারা ইনডিফিনিট পিরিয়ডে সরকারের মেয়াদকে দীর্ঘায়িত করতে চায়।

বিশেষ করে নতুন দল, যেটা সরকার কোলে পিঠে করে তৈরি করছে, তারা ইনডিফিনিট পিরিয়ডের জন্য সময় চায়, বলছিলেন তিনি।

সেক্ষেত্রে সরকার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেলে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর