
১৮ জুন রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত সংলাপের তৃতীয় দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : সংগৃহীত
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপ ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যত যা চলছে, তা আর কেবল মতবিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলই যেন এখন নিজেদের প্রাসঙ্গিক প্রমাণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সংলাপ মঞ্চে করছেন অভিমান, বর্জন ও প্রত্যাবর্তনের নাটক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসবই নিজেদের অবস্থানের জানান দেওয়ার একটি সূক্ষ্ম কৌশল।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংলাপের তৃতীয় দিনে ঘটে যাওয়া একাধিক নাটকীয় ঘটনার সূত্র ধরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সংলাপের মঞ্চ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মান-অভিমানের প্রতীকী খেলা।
লন্ডনের ছায়া পড়ে ঢাকার আলোচনায় : ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপ শুরুর আগেই আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের প্রভাব। ওই বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা সরাসরিই জানিয়ে দেয়—বৈঠকের ভাষা ও বার্তা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি নজিরবিহীন। এরপরেই তারা মঙ্গলবারের সংলাপে অংশ নেয়নি।
তবে একদিন পরেই সেই ‘অভিমান’ গলে যায়। কমিশনের পক্ষ থেকে সরাসরি ফোনে যোগাযোগ এবং আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানানো হলে, জামায়াতের প্রতিনিধি দল আবার সংলাপে হাজির হয়। মিলনায়তনে প্রবেশ করে করমর্দন, হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময়—সবকিছুতেই ছিল স্পষ্ট বার্তা: আমরা দূরে সরে ছিলাম, এখন ফিরলাম, কারণ আমাদের গুরুত্ব আছে।
বক্তব্যের লাইনেই অস্বস্তি, উঠেপড়ে সংলাপ ছাড়লেন তিন দলের নেতা : তবে এ দিনে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে গণফোরাম, সিপিবি ও এলডিপির নেতাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আলোচনা চলাকালীন তারা অভিযোগ করেন—তাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অথচ জামায়াতসহ কয়েকটি দল একাধিকবার বক্তব্য রাখছে। এ অবস্থায় হল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন গণফোরামের মিজানুর রহমান, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স ও এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম। বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনে তারা নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সংলাপ থেকে ‘বাইর’ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
যদিও খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এ মান-অভিমান। কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও উপদেষ্টা মনির হায়দার তাদের বুঝিয়ে আবার সংলাপে ফিরিয়ে আনেন। তাদের এ প্রত্যাবর্তনকে অনেকে কৌশলগত বার্তা হিসেবে দেখছেন। তাদের বার্তাটি এমন—আমরা ফিরলাম, কিন্তু মনে করিয়ে দিলাম আমাদের উপেক্ষা করা যায় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংলাপ কেবল বক্তব্য দেওয়া বা শ্রোতা হওয়া নয়—এটি এখন একটি প্রতীকী জায়গা। যেখানে প্রতিটি দল নিজের অবস্থান ও ওজন মাপাতে চায়। জামায়াতের একদিনের অনুপস্থিতি, আবার ফিরে আসা বা সিপিবি-গণফোরাম-এলডিপির প্রতিবাদ—সবই রাজনৈতিক গুরুত্বের এক প্রকার ‘স্টেটমেন্ট’। কেউ অংশ নিচ্ছে, কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করছে। আবার কেউ সরাসরি কিছু বলছে না—প্রতিটি আচরণের পেছনেই রয়েছে নিজেকে আলোচনায় অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা।
তারা বলছেন, জাতীয় ঐক্যমত্যের সংলাপ রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তবে এ সংলাপে যে নাটকীয়তা, মান-অভিমান এবং কৌশলগত অনুপস্থিতি ও প্রত্যাবর্তনের খেলা চলছে, তা বলে দেয়—এখানে মতবিনিময়ের পাশাপাশি চলছে প্রতিপক্ষের চোখে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার প্রচেষ্টা। সংলাপের আসল উদ্দেশ্য তাই কিছুটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। যার ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাজনৈতিক মর্যাদা রক্ষার টানাপোড়েন।
এনএমএম/এমবি