তারেক রহমানের দেশে ফেরার নেপথ্যে নিরাপত্তা ও নির্বাচন

ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১৫:১৬

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠককালে তারেক রহমান | ছবি : সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনের পার্ক লেন হোটেল ডোরচেস্টারে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষ হতেই এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠেছে— কবে দেশে ফিরবেন তারেক। এদিকে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা ঢাকায় কোথায় থাকবেন, সেই বাড়ির প্রস্তুতির খবরও হচ্ছে গণমাধ্যমে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর দশমাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কেন তার দেশে ফেরা হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা জানার চেষ্টা করেছে তারেক রহমানের দেশে ফেরার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও। চলুন, বিবিসির বিশ্লেষণ দেখে নিই—
২০২৪ সালের পাঁচই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর দ্রুততার সাথে তারেক রহমান প্রায় সকল মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এ ছাড়া একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ আরো যেসব মামলায় সাজা হয়েছিল, আদালতের রায়ে তার সবগুলো থেকেই তিনি খালাস পেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনও ধরনের বাঁধা নেই।
দেশে ফিরবেন কবে
আইনি এবং রাজনৈতিক সকল বাধা দূর হলেও দীর্ঘ প্রায় সতের বছর দেশের বাইরে থাকা তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, এ বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি।
দলীয় সূত্র এবং তার ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, তারেক রহমান দেশে ফিরেই আগামী নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। সেই হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের ফিরবেন, এমন ধারণাই দেওয়া হচ্ছে।
তারেক রহমানের একজন উপদেষ্টা মাহদী আমিন জানান, কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি, তবে নির্বাচনের আগে তিনি দেশে আসবেন। এ ব্যাপারে তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, খুব দ্রুতই ইনশাআল্লাহ নির্বাচন হবে আগামী বছর রমজানের আগে— অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং অবশ্যই তার আগে তিনি ফেরত আসবেন। যথোপযুক্ত আইনি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ যখন সৃষ্টি হবে, যেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, সবার জন্য ভালো— উনি অবশ্যই নির্বাচনের আগে সেই সময়টাতে আমাদের মাঝে উপস্থিত হবেন।’
সম্প্রতি লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের নির্বাচন ইস্যুতে বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠক থেকে বাংলাদেশে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে যৌথ ঘোষণা এসেছে। লন্ডনে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির।
তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে হুমায়ুন কবির সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ না করে বলেছেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যেই দেশে ফিরে দলকে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান।’
তিনি বলেন, ‘দেখি আমরা প্রথমে নির্বাচনের তারিখটা ঘোষণা হোক। তারপরে ইনশাআল্লাহ একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হি উইল বি কামিং ব্যাক ইন টু থাউজেন্ড এন্ড টোয়েন্টি ফাইভ। বাংলাদেশের মানুষ ওনাকে এই বছরেই পাবে ইনশাআল্লাহ।’
নিরাপত্তার ইস্যু কেন
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দশ মাস পেরিয়েছে। এতদিনেও কেন তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না, সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা এবং সাজা নিয়ে আইনগত যে সমস্যা ছিল, সেটি দূর হয়েছে। পাঁচই অগাস্টের পর থেকেই রাজনৈতিকভাবেও সমগ্র বাংলাদেশে বিএনপির আধিপত্য দৃশ্যমান।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে আসছেন না কেন— এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে জানান, তারেক রহমানের নিরাপত্তার ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আইনি প্রক্রিয়া আর নিরাপত্তা- দুটো আলাদা বিষয়।
তিনি বলেন, ‘ওনার মতো লিডারের সিকিউরিটি কনসার্ন (নিরাপত্তার উদ্বেগ) স্বাভাবিকভাবে আছেই। এটা এশিয়া মহাদেশের রাজনীতিতে নাথিং নিউ। পলিটিক্স ইন দ্য এশিয়া প্যাসিফিক অর সাউথ এশিয়া এনি হোয়্যার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড এই ধরনের সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডারের নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়তো আছেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি আসবেন, অবশ্যই আসবেন। আসার আগেতো একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে। সরকারেরও একটা নিশ্চিত এনভাইরনমেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে একটা স্পেস ক্রিয়েট করতে হবে, যেখানে পলিটিক্যাল লিডারস আর সেইফ, সিকিওর।’
বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানই এখন প্রধান নেতা। আগামী নির্বাচনে তার নেতৃত্বেই দলটি নির্বাচন করবে এবং ধারণা করা হচ্ছে দল ক্ষমতায় এলে তিনিই হবেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু দেশে নিরাপত্তাহীনতা কেন এবং সমস্যা কোথায়— এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডারের নিরাপত্তা ইস্যু সবসময় থাকবে।
‘গত পনের বছর উই হ্যাভ আ রগ ফর্ম অফ গভর্মেন্ট। যারে মনে হয় তুলে নেওয়া হয়েছে, যারে মনে হয় হত্যা করা হয়েছে। মানে এটা একটা অ্যাবনরমাল সিস্টেম।’
‘আমরা দেখেছি তো হাউ পলিটিসাইজ ওয়াজ পুলিস ফোর্স। আপনার মিলিটারির একটা এলিমেন্টও পলিটিসাইজ (দলীয়করণ) করা হইছে। তো এইগুলাকে একটু ক্লিয়ার আপ করতে তো স্বাভাবিকভাবে একটা স্পেস সরকারেরও দরকার আছে। সো দে আর ডুইং দ্যাট। আশা করছি, শিগগিরই সেই জায়গাটা তৈরি হবে’— যোগ করেন হুমায়ুন কবির।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা আসার পর তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন এবং ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনে যান। পরে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা প্রয়াত মওদুদ আহমদ তাঁর 'কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)' বইতে লিখেছেন, ‘এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এক এগারোর সরকারের সময় তারেক রহমান বিদেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে সময় তিনি (তারেক রহমান) গিয়েছিলেন সেসময়তো তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছিল। আর চিকিৎসাও একটা লক্ষ্য ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলবো তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে খালেদা জিয়ার ওপর একটা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল ওই সময়ের সেনা নেতৃত্ব। সেই সেনা নেতৃত্বতো এখন নাই। সুতরাং সেই সমস্যাটা আমি আর দেখি না।’
‘তারপরেও একটা আশঙ্কা থাকতে পারে। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিটা হচ্ছে প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ভরা। তার প্রতি যে আচরণ সে সময় করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো ইনভলব ছিল। তারা হয়তো ভাবতে পারে তারেক ফিরে এলে তিনি যদি প্রতিশোধ নেন। তো এরকম একটা চিন্তা থাকতে পারে। কারণ আমাদের রাজনীতিতে এটা হরদম চলছে।’
- এটিআর