Logo

রাজনীতি

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে বিএনপি

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:০৩

ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জে বিএনপি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘণ্টা বাজছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। তবে এই হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন ত্রিমুখী সংকটের মুখোমুখি।

এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ওপরই নির্ভর করছে দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ। প্রথম চ্যালেঞ্জটি দলের একেবারে ভিতরে। এটি হলো ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন এবং দলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে। তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জটি হলো ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সমীকরণ মেলানো। এই তিনটি কাঁটাপূর্ণ পথ বিএনপি কীভাবে পাড়ি দেয়, তার ওপরই দেশের আগামী দিনের রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে।

প্রথম চ্যালেঞ্জ: দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও ত্যাগীদের

মূল্যায়ন: বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বহু নেতাকর্মী জেল, জুলুম এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা দলের

জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এখন তাদের যথাযথ মূল্যায়নের সময় এসেছে। এটিই এখন বিএনপির হাইকমান্ডের জন্য প্রধান একটি পরীক্ষা।

সমস্যাটি আরও জটিল হয়েছে কিছু 'হাইব্রিড' নেতার কারণে। অভিযোগ রয়েছে, এসব নেতা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর তারা এখন বিএনপিতে প্রভাবশালী হওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দখলে নিচ্ছেন। এমনকি আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্যও তারা জোর তদবির শুরু করেছেন।

এমন পরিস্থিতি দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের মধ্যে তীব্র হতাশা তৈরি করছে। তারা মনে করছেন, তাদের অবদানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। যদি এই অনুভূতি বাড়তে থাকে, তবে দলে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে তীব্র অনৈক্য। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে তৃণমূল পর্যন্ত। মনোনয়নবঞ্চিত প্রভাবশালী নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে পারেন। এ দুটি পরিস্থিতিই নির্বাচনের মাঠে বিএনপির জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনবে।

দলের ভেতরে ষড়যন্ত্রকারীরাও এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অতীতে যারা দলভাঙার খেলায় মেতেছিল, তারা আবারও সক্রিয় হতে পারে। বিএনপি অবশ্য এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দলের হাইকমান্ড পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে এক-এগারোর সময় যারা সংস্কারপন্থি সেজে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, তাদের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সে তালিকা এখন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘‘মনোনয়ন নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা এখনো শুরু হয়নি। ভোটের তফসিল ঘোষণার পরই এ বিষয়ে কাজ শুরু হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এত আগে আলোচনা শুরু করলে দলে বিভেদ তৈরি হতে পারে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার। এবার কারও মনোনয়নের জন্য তদবির করার কোনো সুযোগ থাকবে না। প্রত্যেককে নিজের মনোনয়ন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। দল এবার ত্যাগী, যোগ্য এবং বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীকেই বেছে নেবে। সবার আমলনামা হাইকমান্ডের কাছে আছে।’’

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ : অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ

বিএনপির দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জটি হলো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর সুসম্পর্ক থাকা অপরিহার্য। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে লন্ডনে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের পর একটি যৌথ ঘোষণা আসে। ওই ঘোষণায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত ছিল। এরপরই সারা দেশে নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করে। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু সেই স্বস্তির বাতাস এখন অনেকটাই স্তিমিত। নির্বাচন নিয়ে আবার সংশয়ের কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। খোদ বিএনপির নেতারাই এ নিয়ে তাদের শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা, কোনো অদৃশ্য শক্তি হয়তো নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। যদি নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে কোনো দূরত্ব বা জটিলতা তৈরি হয়, তবে তা পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়ার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এটি বিএনপির নির্বাচনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেও বড় বাধা সৃষ্টি করবে।

তবে এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা এখনই হাল ছাড়তে নারাজ। তারা বলছেন, কেবল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যৌথ ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে তারা বসে নেই। বিএনপি তার নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে যদি কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র হয়, তবে বিএনপি বসে থাকবে না। প্রয়োজনে আবারও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচিতে যাবে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদল চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকের পর দেশের মানুষ আশাবাদী হয়েছিল।’’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘‘এখন যদি সঠিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করা হয়, বিএনপির নেতাকর্মীরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। সময়ের প্রয়োজনে যা যা করার দরকার, আমরা তাই করব।’’

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ: ইসলামপন্থি দলগুলোর পিআর দাবি ও জোটের রাজনীতি

বিএনপির জন্য তৃতীয় এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জটি হলো ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ দেশের অধিকাংশ ইসলামপন্থি দল এখন একটি নতুন দাবিতে সোচ্চার। তারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। এর সঙ্গে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনেরও দাবি জানাচ্ছে।

তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং এমনকি কয়েকটি ভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনও। গত শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে এই ঐক্যের একটি স্পষ্ট চিত্র দেখা গেছে। সেখানে দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, "পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আজকের এই জনসমুদ্র পিআরের পক্ষের জনসমুদ্র।"

জামায়াতে ইসলামীও পিআর পদ্ধতির জন্য জোরালো অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু ইসলামপন্থি দলগুলোর এই অবস্থানকে মোটেই ভালোভাবে দেখছে না বিএনপি। বিএনপি নেতারা এই দাবিকে নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। এ নিয়ে দলের ভিতরে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে তাদের দলের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘যারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে। যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চান, তাদেরও একটি উদ্দেশ্য আছে। হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা, না হয় বাংলাদেশে নির্বাচন হতে না দেওয়া। এটাই তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে।’’ স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস আরও কঠোর ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, "একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। তারা এই জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। আমি সবাইকে অনুরোধ জানাব, আপনারা আউল-ফাউল কথাবার্তা বলবেন না। এসব কথা বলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করবেন না।" তিনি সমাবেশের শক্তি দেখানোর সমালোচনা করে বলেন, ‘‘সমাবেশ দিয়ে যদি জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা যেত, আমরা সারা বাংলাদেশকে একদিনে সমাবেশের আওতায় আনতে পারি। এটা কোনো সিস্টেম হলো না।’’

এই পরিস্থিতি বিএনপিকে একটি উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে। একদিকে ভোটের মাঠে শক্তিশালী ঐক্য গড়তে ইসলামপন্থি দলগুলোকে তাদের প্রয়োজন। অন্যদিকে, পিআর পদ্ধতির মতো একটি মৌলিক নীতিগত পরিবর্তনে তারা রাজি নয়। বিএনপি মনে করে, এটি তাদের রাজনৈতিক আদর্শের পরিপন্থি এবং এতে আন্তর্জাতিক মহলেও ভুলবার্তা যেতে পারে। এই দুই বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এখন বিএনপির জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো কোনো কোনো নেতা বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হচ্ছে। এটাকে শুধু শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করার দরকার নেই। রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বিমত থাকবেই। এটাতে কোনো অসবিধা নেই।’’

সব মিলিয়ে বিএনপি এখন এক জটিল রাজনৈতিক আবর্তে রয়েছে। একদিকে ঘরের কোন্দল সামাল দেওয়ার চাপ। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিশ্বাস ও দূরত্বের এক সূক্ষ্ম দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামপন্থি মিত্রদের নতুন দাবি, যা জোটের ঐক্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই ত্রিমুখী সংকট থেকে বিএনপি কীভাবে বেরিয়ে আসে, তার ওপর দলটির নির্বাচনি ভবিষ্যৎ এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করছে। আগামী দিনগুলোই বলে দেবে, বিএনপি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সাফল্যের বন্দরে পৌঁছাতে পারবে, নাকি সংকটের আবর্তে আরও তলিয়ে যাবে।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বিএনপি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তারেক রহমান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর