
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণায় বিএনপিতে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করলেও বিপরীত চিত্র জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপিতে। অনুসন্ধান বলছে, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির নির্বাচনি বার্তা মাঠ পর্যায়ে এখনো পরিষ্কার না। দল তিনটির শীর্ষ নেতারা নির্বাচনের আগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ’-এর আইনি ভিত্তি দাবি তোলার পর তৃণমূল এখনো ভোট নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে হার্ডলাইনে যাওয়ার ইঙ্গিতও রয়েছে এসব দলের। বিষয়টিতে দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যও ভিন্ন ভিন্ন। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বর্ষপূর্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও রমজানের আগে ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার দুদিন পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সোমবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাতে ‘না’ ভোট চালুসহ নির্বাচন বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংশোধনী আনা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঘোষণা ও ইসির কর্মকাণ্ডের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠ পর্যায়ে কী প্রভাব পড়েছে তা জানার চেষ্টা করেছে দৈনিক বাংলাদেশের খবর। অনুসন্ধানে চারটি দলের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নির্বাচনি আমেজ লক্ষ্য করা গেছে। যার নেপথ্যে দলগুলোর ‘হাইকমান্ডের অবস্থানগত’ বিষয় কাজ করছে।
বিএনপি
জানা গেছে, নির্বাচন ঘোষণাকে দলের হাইকমান্ড স্বাগত জানানোর পর বিএনপি প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। তাদের মধ্যে এক ধরনের নির্বাচনি আমেজ কাজ করছে। দলটির একই আসনের অনেকেই দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কাছে যেতে শুরু করেছেন। আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন টিকিট পাওয়ার লক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের নামে শোডাউনও দিচ্ছেন। গত তিন দিনে দেশের বেশির ভাগ নির্বাচনী আসনে এ চিত্র দেখা গেছে।
যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, হাইকমান্ড নির্বাচন ঘোষণাকে স্বাগত জানোনোর কারণে দলের বার্তা মাঠ পর্যায়ে স্পষ্ট। সবাই এখন মাঠে নেমে পড়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচন ঘোষণার পর দেশ ইতিমধ্যে নির্বাচনী ট্রেনে। আমরা নির্বাচন ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছি। দলের প্রার্থীরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ গণতান্ত্রিক পথে এগোবে।’
জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামীতে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচন ঘোষণা ও ইসির তফসিল ঘোষণার তোড়জোড়ের পরও দলটির প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনি আগ্রহ দেখা যায়নি। যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও গাইবান্ধার একাধিক আসনে খোঁজ নিয়ে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। আগে থেকেই দেশের বেশির ভাগ আসনে দলটির এমপি প্রার্থী সিলেকশন করা রয়েছে।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে মাঠ পর্যায়ের অনেকেই হতাশ হয়েছেন। দলের কেন্দ্র বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন। আগে থেকেই আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি ছিল, তাই নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর আমরা তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণায় নামিনি।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নির্বাচন ইতিবাচক হলেও জুলাই ঘোষণাপত্রে তারা হতাশ। তিনি বলেন, ‘এ সরকারের কাছ থেকে জনগণ ভালো কিছু আশা করেছিল। কিন্তু আমরা দেখছি সরকার একটি বড় দলের মতামতের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।’
জুলাই সনদে নির্বাচন ও পিআর পদ্ধতিসহ ঘোষিত সাত দফা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময় রয়েছে।
এদিকে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াতে ইসলামী আজ বুধবার ঢাকায় সমাবেশেরও ডাক দিয়েছে। ঢাকার দুই মহানগর এ সমাবেশের আয়োজন করছে।
ইসলামী আন্দোলন
জামায়াতের মতো একই চিত্র চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশেও। দলটির কোনো প্রার্থীর মাঝে এখনো নির্বাচনী আমেজে নেই। যদিও ইসলামী আন্দোলনও বেশিরভাগ আসনে আগেই প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে তারা ভোটে যাবেন কিনা ভেবে দেখবেন। এই অবস্থায় ভোটে যাওয়া অসম্ভব।
তিনি জানান, সাধারণ মানুষ চাঁদাবাজদের বিপক্ষে ভোট করবেন কীভাবে? সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, সন্ত্রাস দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই ব্যর্থতা অন্তর্বর্তী সরকারের সব অবদান ছাপিয়ে যাচ্ছে। এখন সন্ত্রাস দমনে সরকার যদি কঠোর না হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচনও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এনসিপি
গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এনসিপিতেও নির্বাচনী প্রভাব পড়েনি। দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও গণহত্যার বিচার ও সংস্কার ভাবনা রয়েছে। এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) যুগ্ম-সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আগে নির্বাচনের কোনো চিন্তা নেই এনসিপিতে।
একাধিক সূত্র বলছে- জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ে কেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় প্রভাব পড়েনি তার নেপথ্যে বিশেষ কারণ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্টের চিত্র দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট। ওইদিন এ তিনটি দলই সংবাদ সম্মেলন করে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল এই ধরনের।
জামায়াত ইসলামী নির্বাচন ঘোষণাকে ইতিবাচক দেখলেও দলটির বক্তব্য ছিল নির্বাচন জুলাই সনদের ভিত্তিতে হতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দলটির শীর্ষ নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানিয়েছিলেন। ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’ জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের দাবিতে তিনি প্রয়োজনে আন্দোলনেরও ঘোষণা দেন সংবাদ সম্মেলনে।
এনসিপির সংবাদ সম্মেলনেও দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, সরকারকে অবশ্যই গণহত্যার বিচার ও সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। তারপরও নির্বাচনের দাবি ছিল তার।
একই দিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিয়ে নির্বাচন ঘোষণা সংস্কারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। পিআর পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া ও লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে ভোট সুষ্ঠু হবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।
দল তিনটির শীর্ষ নেতাদের নির্বাচন ঘোষণা ও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের পর মাঠ পর্যায়ে প্রভাব পড়েছে। দলের হাইকমান্ডের বার্তা এখনো তৃণমূলে স্পষ্ট নয়।
এ দিনটি দল ছাড়াও বাংলাদেশ ফেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা মামুনুল হকের দলেও একই অবস্থা। নির্বাচন ঘোষণার পর তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ বাস্তবায়ন না করে নির্বাচন আয়োজন জাতির সঙ্গে এক প্রকার প্রতারণা। এতে করে নতুনভাবে ফ্যাসিবাদ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে।
একাধিক সূত্র বলছে, জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশে খেলাফত মজলিশসহ কয়েকটি দল জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নিম্ন ও উচ্চ উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে হার্ডলাইনে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঐকমত্য কমিশন ফের দলগুলোকে নিয়ে বসার যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সেখানে তারা এ দাবিগুলো বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দিবে। কমিশন দাবি না মানলে তারা ফের মাঠের আন্দোলনেও নামতে পারে। যার প্রমাণ মিলছে, জামায়াত বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়ার মাধ্যমে।
বিকেপি/এমএইচএস