Logo

রাজনীতি

মিছিলে বাড়ছে লোক

কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের ‘পুনরুজ্জীবনে’ অর্থযোগান দিচ্ছে কারা?

নুর মোহাম্মদ মিঠু

নুর মোহাম্মদ মিঠু

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৪

কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের ‘পুনরুজ্জীবনে’ অর্থযোগান দিচ্ছে কারা?
  • বিদেশে বসে নির্দেশ দিচ্ছেন পলাতকরা, করছেন তদারকিও  
  • মন্ত্রী-এমপিদের ‘ক্যাশিয়ার’ খ্যাত ব্যবসায়ীরা দিচ্ছেন অর্থযোগান
  • দুদকের নজরে আর্থিক নেটওয়ার্ক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট

শীর্ষ নেতারা পলাতক ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও রাজপথে ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ও নিয়মিত গ্রেপ্তার অভিযান উপেক্ষা করেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, ককটেল বিস্ফোরণ আর সরকারবিরোধী শ্লোগানে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠছে দলটির নেতাকর্মীরা। দিনকে দিন মিছিলে নেতাকর্মীর উপস্থিতিও বাড়ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার ডিক্রিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই রাজপথে দখল প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক পুনরুত্থানের চেষ্টা করছে দলটি। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এই পুনরুত্থানের পেছনে কাজ করছে একটি শক্তিশালী আর্থিক নেটওয়ার্ক, যার নেপথ্যে রয়েছে ‘ফ্যাসিস্ট’ আমলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানিয়েছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের নতুন করে রাজপথে উত্থানের চেষ্টার নেপথ্যে এমন এক গোষ্ঠী কাজ করছে, যারা ‘ফ্যাসিস্ট আমলে’ সরকারি প্রকল্প, তেল-গ্যাস, টেন্ডার ও আমদানি খাতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। তখনকার এমপি-মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ এসব ব্যবসায়ী রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন ‘উচ্ছিষ্টভোগী’ সেসব ব্যবসায়ীরাই এখন পলাতক কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে মাঠপর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে অর্থের জোগান দিচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থপ্রবাহ বন্ধ না হলে রাজপথে দলটির এসব নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পলাতক কিছু প্রভাবশালী নেতা বিদেশ থেকে এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে মাঠের নেতাকর্মী ও আর্থিক যোগানদাতা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তারা শুধু নির্দেশই দিচ্ছেন না, বরং এলাকায় এলাকায় সংঘবদ্ধতার তদারকিও করছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা বলেন, রাজপথে আওয়ামী লীগের নতুন কৌশলের নেপথ্যের চালিকাশক্তিই এখন অর্থনীতি। নেতৃত্ব নেই, কিন্তু টাকা আছে— এই অর্থই এখন তাদের রাজনীতি চালাচ্ছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে এমন একটি আর্থিক সিন্ডিকেটের তথ্যও পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

দুদক ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করতে সক্রিয় আর্থিক সিন্ডিকেটের অন্যতম একজন নাজির আহমেদ। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বিপরীতে ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারে তার অফিস। তিনি টেক্সটাইল কেমিক্যাল ও রঙের কাঁচামাল আমদানিকারক ব্যবসায়ী। ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ টানা ১৫ বছর ধরে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তৎকালীন রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক ও তার স্ত্রী হনুফা আক্তারের ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী রাজনৈতিক মহলে তাদের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন।

দুদক সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সিঙ্গাপুরে পালিয়ে থাকা মুজিবুল হকের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে নাজির আহমেদকে দেওয়া হয় ৪০ লাখ টাকা। ঢাকার পল্টন, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সে অর্থের একটি অংশ খরচও করেন বলে জানা গেছে। নাজির আহমেদ চৌদ্দগ্রামে গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ, মাছের ঘের, স্থানীয় বাজারে নিজ নামে মার্কেট। ঢাকার শান্তিনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বিশাল অট্টালিকা। দেশের বাইরে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরেও গড়েছেন বিপুল সম্পদ। এসব অভিযোগ ইতোমধ্যে দুদকের নজরে এসেছে বলেও জানায় সূত্রটি।

দুদক সূত্র আরও জানায়, নাজির আহমেদের মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী একইভাবে অর্থ জোগাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম রুহুল আমিন, ডানহিল করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা। ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রুহুল আমিন ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ সময় কেমিক্যাল বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের নির্বাচনী ফান্ডেও অর্থ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনিও মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন বলে চাউর রয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, এমন আরও একাধিক ব্যবসায়ীর তথ্য তাদের হাতে এসেছে। একই সঙ্গে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও এসব নেটওয়ার্কের আর্থিক প্রবাহ ও সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করছে। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিগগিরই এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান শুরু হবে।

রাজধানীজুড়ে যেসব ছোট ছোট মিছিল ও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, তার পেছনেও রয়েছে টাকার হাত। অধিকাংশই পুরনো ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মী, যারা রাজনৈতিক বিশ্বাসের চেয়ে অর্থের প্রলোভনেই এখন রাজপথে নামছেন বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাকির হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগঠন কার্যক্রম নিষিদ্ধ অবস্থায়ও এভাবে সক্রিয় থাকতে পারছে, এটা স্বাভাবিক রাজনীতি নয়। অর্থের প্রভাবেই রাজপথে দিনকে দিন আন্দোলনের গতি বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, টাকার বিনিময়ে রাজনীতি ভবিষ্যতে বড় সহিংসতারও জন্ম দিতে পারে। সে কারণে বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা— সবখানেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমন কমিশন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর