৪৫ আসনে অসন্তোষ, ২৫টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা
এম. ইসলাম
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৭
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা নিয়ে কমপক্ষে ৪৫টি আসনে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যার মধ্যে ২৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির পদধারী নেতারা। স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে স্বাভাবিকভাবে ভোটাররা বিভক্ত হবে। এর ফলে অন্য দলের প্রার্থীরা সুযোগ নিতে পারলেও বিএনপি মনোনীতরা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।
গত ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন আসনে দলটির নেতারা নানাভাবে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির একাধিক সূত্র মতে, তফসিলের আগেই অবশিষ্ট ৬৩ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। যার মধ্যে দলটির শরিকদের ৪০টির বেশি আসন দেওয়া হতে পারে। এছাড়া কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা হতে পারে। আসন চূড়ান্ত হওয়ার পর দলটি বিশেষ করে শরিকদের ছেড়ে দেওয়া আসন ও প্রার্থী পরিবর্তন করা আসন নিয়ে ফের সংকটে পড়তে পারে। সেখানেও বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। বাড়তে পারে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা।
বিএনপির বেশির ভাগ নেতার ভাষ্য হচ্ছে, গত প্রায় ১৭ বছর জোট নেতারা স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। তাই দীর্ঘদিন মামলা ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীরা শরিক দলের নেতার জন্য কাজ করতে চাইবে না- এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বড় দলে মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ থাকে। কারণ, একই আসনে অনেকেই যোগ্য থাকেন। কিন্তু সবাইকে তো মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে, শেষ সময়ে সবাই দলের প্রতীকের বাইরে যাবেন না।’
শরিকদের কিছু আসনে চ্যালেঞ্জ আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বড় দল হিসেবে বিএনপি অভারকাম করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’
বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কিছু আসনে চরম অসস্তোষ দেখা গিয়েছে। অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ফারজানা শারমিন পুতুলের মনোনয়ন পরিবর্তনে বড় ধরনের শোডাউন দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু।
তিনি বলেন, ‘পুতুলকে দেওয়া মনোনয়ন পরিবর্তন না করলে জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচনে লড়ব। আশা করছি দল মাঠের নেতাকর্মীদের চাওয়া মাথায় রেখে রাজপথে থাকা নেতাদের মূল্যায়ন করবে।’
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-কালীগঞ্জ) আসনে কাজী আলাউদ্দিনের মনোনয়ন পরিবর্তন করে ড্যাবের উপদেষ্টা বিশিষ্ট চিকিৎসক শহিদুল আলমকে মনোনয়নের দাবিতে হরতালসহ লাগাতার সড়ক অবরোধসহ কর্মসূচি পালন করেন নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন পরিবর্তন না করলে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
মাগুরা-২ (শালিখা-মহম্মদপুর) আসনে অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ায় সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল।
ঢাকা-১৪ আসনে মায়ের ডাক এর প্রতিষ্ঠাতা সানজিদা ইসলাম তুলিকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদ ও তাকে বয়কট করে মশাল মিছিল করায় দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক সাজুকে বিএনপি শোকজও করেছে।
সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা) আসনেও বহিষ্কৃত নেতা আব্দুর রউফের মনোনয়ন বাতিলেও ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন নেতাকর্মীরা। সেখানে আব্দুল আলিমকে চান নেতাকর্মীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ-বিজয়নগরের একাংশ) আসনে কারও নাম ঘোষণা না করায় সেখানে জমিয়ত নেতা জুয়ায়েদ আল হাবিবকে মনোনয়ন দেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। মনোনয়ন না পেলে আলোচিত বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নোয়াখালী-৫ আসনের প্রার্থী ফখরুল ইসলামকে পরিবর্তন করার দাবিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরীর সমর্থকরা লাগাতার কর্মসূচি পালন করছেন। ফখরুল ইসলাম আলোচিত এস আলম গ্রুপের সহযোগী বলে বিএনপির কেন্দ্রে অভিযোগ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ) আসনে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এম কয়ছর আহমদকে মনোনয়নের প্রতিবাদে সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়ীয়া) আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আখতারুল আলম ফারুককে মনোনয়ন দেওয়ায় এ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি প্রয়াত শামছ উদ্দিন আহমদের ছেলে তানভির আহমেদ রানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক এমপি এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে। এ আসনে বকশীগঞ্জ বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে সালাউদ্দিনকে প্রার্থী করার পর থেকে বিক্ষোভ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ আসনের মনোনয়ন পরিবর্তন না করলে শেষ পর্যন্ত আসলাম চৌধুরী স্বতন্ত্র ভোট করার ঘোষণা দিয়েছেন।
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনটি সমমনা দল গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে দেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ আসনের বিএনপি নেতা হাসান মামুনের সমর্থকরা নুরকে মনোনয়ন দেওয়া হলে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়া প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ঢাকা-১২ ঢাকা-১৫, নারায়ণগঞ্জ-২ নারায়ণগঞ্জ-৩, কুমিল্লা-৬ আসনে, কুমিল্লা-৯, টাঙ্গাইল-৩, দিনাজপুর-২ আসন, নওগাঁ-২, চাঁদপুর-২, চাঁদপুর-৪, সুনামগঞ্জ-১ ও ৫ আসনে, ফরিদপুর-৩, রাজবাড়ী-১, টাঙ্গাইল-১ ও ২, কুষ্টিয়া-২, ৩ ও ৪ আসন, গাইবান্ধা-৪ আসন, পাবনা-৩, পাবনা-৪, জয়পুরহাট-১, জয়পুরহাট-২, নওগাঁ-২, চট্টগ্রাম-১২ ও ১৩, কুষ্টিয়া-৪, সিলেট-৬, ফেনী-২, পাবানা-৩ আসনসহ কয়েকটি আসনে চরম অসন্তোষ চলছে।
জানা গেছে, অসন্তোষ তৈরি হওয়া এসব আসনের অনেক পদধারী বিএনপি নেতা ইতিমধ্যে সরাসরি বিরোধিতা না করলেও ভিন্ন দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন। আর যেখানে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা রয়েছে সেখানে তারা সরাসরি দলের মনোনীতদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এর ফলে, সুযোগ পবেন বিশেষ করে জামায়াত জোটের প্রার্থীরা। কারণ, গত বছরের ৫ আগস্টের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পর আওয়ামী লীগ সাময়িক নিষিদ্ধ থাকায় দলটি এখন নির্বাচনের বাইরে। তাই বিএনপির বাইরে এখন বড় নির্বাচনী জোট হচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমরা অন্য দলের কোন্দল কাজে লাগাবো বিষয়টি এরকম নয়। তবে, ভোটের মাঠে নানান কৌশল থাকে যা কাজে লাগিয়ে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীরা জয়লাভের চেষ্টা করেন।’ এদিকে, বিএনপি দলটিতে ইতিমধ্যেই অসন্তোষ কমাতে কাজ করছে। সংক্ষুব্ধদের সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। তাদের নানাভাবে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্যও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
বিকেপি/এমবি

