জাতীয় মিম্বার থেকে
নেক কাজে ভালো লাগা ঈমানের পরিচয়
মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল মালেক
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮
প্রিয় মুসুল্লিগণ, আমি একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। অর্থ- ‘আর যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্য ধারণ করে এবং সালাত কায়েম করে। আর আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে। ভালো কাজের দ্বারা মন্দ কাজকে প্রতিহত করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের শুভ পরিণাম। (সুরা রা’দ, আয়াত ২২)
যে গুণাবলী এ আয়াতে বলা হয়েছে, সে গুণাবলীর অধিকারীরাই হলেন বুদ্ধিমান। আল্লাহ তাআলা আখেরাতে এই বুদ্ধিবান লোকদেরকে জান্নাত দান করবেন। তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পূর্বপুরুষ, যারা নেককার ছিলেন তারাও প্রবেশ করবে জান্নাতে। তাদের নেককার স্ত্রীগণও প্রবেশ করবে জান্নাতে। নেককার সন্তানগণ এবং কেয়ামত পর্যন্ত তার সকল নেককার বংশধর সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতের প্রতিটি দরজা দিয়ে ফেরেশতারা এসে তাদেরকে বলবে, আসসালামু আলাইকুম! দুনিয়াতে তোমরা সবর করেছো, সে সবরের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহতালা তোমাদের জান্নাত দিয়েছেন।
এ আয়াতে সবর-ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে। সবরের মধ্যে প্রথম কথা হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর যা ফরজ করেছেন, মজবুতির সাথে তা আদায় করা। ফরজ আদায় করার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়া। একদিন আদায় করলাম, একদিন করলাম না বা একদিন করলাম, আরেক দিন ছাড়লাম; এমন নয়। মজবুত থাকতে হবে। এটা হলো সবর-ধৈর্যের প্রথম কথা।
আমরা মনে করি, মুসিবত আসলে ধৈর্য ধারণ করা; আর এটার নামই সবর। অবশ্য এটাও সবর। কিন্তু সবর কেবল এটা নয়। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মধ্যে মজবুত থাকা, দৃঢ় থাকা। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা থেকে বাঁচা এবং আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে মজবুত থাকা। সুন্দরভাবে ইবাদত করা এবং নিয়মিত করা। এটা সবরের প্রথম কথা।
নামাজ শুরু করে তাড়াহুড়ো হুলস্থূল করে শেষ করে দিলাম। এটা সবর হলো না। ইবাদত সুন্দরভাবে আদায় করার জন্য নিজেকে ধরে রাখা হল সবর। বালা মুসিবত আসলে হায়-হুতাশ না করে ধৈর্য ধারণ করা। যা হয়েছে আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। -ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমরা সবাই আল্লাহর জন্য আর আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব আবার। সুতরাং আল্লাহর ফয়সালার উপর আমি সন্তুষ্ট।
মুসিবতের সময় আমার কী করণীয়; এটা জেনে আমল করব। হাত-পা গুটিয়ে বসে যাব, হায়-হুতাশ করতে থাকব, হীনম্ম্যতার শিকার হব; এটা সবরের পরিপন্থী। সবরের দাবি হলো আমি স্থির থাকার চেষ্টা করব। যত বড় মুসিবতই হোক, আল্লাহর ফয়সালের উপরে সন্তুষ্ট থাকব।
তাহলে সবরের মোট চারটি বিষয়। এক. আল্লাহর যা উপর ফরজ করেছেন, তা আদায়ের ক্ষেত্রে মজবুত থাকা। দুই. ফরজগুলো নিয়মিত ও সুন্দরভাবে আদায় করা। তিন. হারাম, গুনাহের কাজ ও আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকা। চার. বলা মুসিবতের সময় ধৈর্য ধারণ করা। এ চারটা বিষয়ের নাম হলো সবর।
সবর ছাড়া একজন বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে না। সবর ছাড়া দ্বীনদার হওয়া সম্ভব না, নেককার হওয়া সম্ভব না।
শয়তান মানুষের পিছনে লেগেই আছে। চারদিকের পরিবেশ যদি ঈমানের পরিবেশ না হয়, দীনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ যাতে আল্লাহর আনুগত্য হতে না পারে, আল্লাহর ইবাদতের লাইনে অগ্রসর না হতে পারে, সেটার জন্য অনেক ধরনের বাধা। কোনো বাধার কারণেই যদি আমি দুর্বল হয়ে যাই, তাইলে ইবাদত করা সম্ভব হবে না। আমল করা সম্ভব হবে না। গুনাহের দিকে টেনে নেওয়ার জন্য কতো কিছুই আছে। শয়তানের ধোঁকা, নফসের ধোঁকা, চারদিকের পরিবেশের আকর্ষণ।
এজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয়, ‘হে আল্লাহ! ঈমানের প্রতি, নেক আমলের প্রতি আমার আকর্ষণ সৃষ্টি করে দেন। গুনাহের প্রতি আমার অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করে দেন।’ এটি হাদিসের দোয়া।
গুনাহ থেকে বাঁচতে হলে মজবুত থাকতে হবে। শয়তানে ওয়াসওয়াসায় যদি আমি কাত হয়ে যাই, তাহলে কখনো গুনাহ থেকে বাঁচতে পারব না। নেক কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে; এই কষ্ট সয়ে নিতে হবে। কষ্ট হলেও আমি নেক কাজ ছাড়ব না। এগুলোর নাম হলো সবর।
গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা, দূরে থাকা; এটা কঠিন মনে হয়, কষ্ট মনে হয় ঈমানী দুর্বলতার কারণে। ঈমান মজবুত হলে কোনো বিষয় না। ঈমান মজবুত হলে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা একেবারে সহজ। নেক আমল করা একেবারে সহজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলছেন, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছো বলে তোমাদের প্রতি শান্তি। আর আখেরাতের এ পরিণাম কতই না উত্তম! (সুরা রা’দ, আয়াত ২৪)
হাদিসে এসেছে, নেক আমল করে যদি ভালো লাগে আর গুনাহ হয়ে যাওয়ায় মনটা খারাপ লাগে। আহ! কিভাবে এই পাপটা হয়ে গেল? এই পাপটা কিভাবে আমি করে ফেললাম? নেক আমলে ভালো লাগে আর গুনাহ হলে খারাপ লাগা এটাই ঈমানের পরিচয়।
কিছুদিন আগে প্রাইমারিতে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হয়েছিল। এখন ঐ প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।
প্রথমে যে প্রজ্ঞাপন এসেছিল ওটা ছিল গুনাহ। পরে ওটা বাতিল করা হলো নেক কাজ। এই নেক কাজের উপরে খুশি হওয়া দরকার কি না? অবশ্যই দরকার। কিন্তু ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে এতে। তবে আমরা ব্যাখ্যার দিকে না তাকাই। একটা নেক কাজ হয়েছে। ওটার জন্য মোবারকবাদ। খারাপ কাজ হলে খারাপ লাগবে, নেক কাজ হলে খুশি লাগবে। নেক কাজের তৌফিক হয়েছে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আলহামদুলিল্লাহ। এটাও হলো ঈমানের পরিচয়।
বুদ্ধিমান হল যাদের মধ্যে আখেরাতের ফিকির আছে। যারা নিজের খালেক ও মালিককে চিনে। সে বুদ্ধিবান। আল্লাহই আমার খালেক, আমার মালিক, আমার রব। তিনি একমাত্র মাবুদ। তার ইবাদত করা আমার উপরে ফরজ।
সবচেয়ে বড় ইবাদত নামাজ। তারা সালাত কায়েম করে। এটা বুদ্ধিবানের পরিচয়, আল্লাহ কোরআনে দিয়েছেন। সালাত কায়েম করা মানে সালাত যথাযথ আদায় করা। আল্লাহ যত ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন, তত ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। নামাজে যতগুলো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব আছে, নামাজের যত শর্ত, যত রুকন- সবকিছু ঠিক যেই তরিকায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ শিখিয়েছেন, ঐ তরিকায় নামাজ আদায় করা। এটা হলো ‘ইকামাতুস-সালাহ’ সালাত কায়েম করা। সুন্দরভাবে, খুশু-খুজুর সাথে, সুন্নাত মোতাবেক, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে শিখিয়েছেন, ঐভাবে নামাজ আদায় করতে হবে।
ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর দোয়া কবুলের বিশেষ সময়। এই সময় নিজের দোয়া নিজে করো। আনুষ্ঠানিকভাবে ইমাম সাহেবের সাথে হাত তুলে মোনাজাত করা দোয়ার একটি পদ্ধতি। কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি নয়। দোয়া আপনি যেকোনো সময় করতে পারেন। আপনার যা আল্লাহর কাছে চাওয়ার আছে, আপনি নিজে নিজে চাইতে থাকেন।
ইমাম সাহেব দোয়া করলেন না মানে এই না যে আমি দোয়া করব না। আমি করি- সুন্নতের পরে করি, সুন্নতের আগে করি, আমার দোয়া আমি করব। আমার যিকিরের কালিমাগুলো হাদীস শরীফে শিখানো হয়েছে- গুলো আমি আদায় করব। এছাড়া আয়াতুল কুরসী, তিন কুল, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার- প্রতি ফরজ নামাজের পরে পড়া যায়।
তাহলে আজকের আলোচনা থেকে বুঝলাম- সবসময় জুমার দুই রাকাত নামাজের পরে খতিব সাহেব হাত উঠিয়ে মোনাজাত দিবেন, জোরে আওয়াজ করে মোনাজাত দিবেন আর আমরা সবাই সঙ্গে দোয়া করতে থাকবো; এই পদ্ধতি জরুরি না। হঠাৎ দেখবেন, আমি সালাম ফিরানোর পরে নিজের দোয়া নিজে করছি, নিজের যিকির নিজে করছি, হাত উঠালাম না; কোনো আপত্তি নেই। কখনো দেখবেন, আমি একপাশে সুন্নাত পড়া শুরু করেছি, আজকে দোয়া পরে করব; এতে কোনো আপত্তি নেই।
শরীয়ত যেটাকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বানায় নাই, ওটাকে আমি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা মনে করতে পারি না। যেটা মুস্তাহাব, ওটা মুস্তাহাব। যেটা মুবাহ, ওটা মুবাহ। শরীয়ত যেটাকে যেই স্তরে রেখেছে, সেটা সেই স্তরেই রাখতে হবে। আর ইমাম সাহেব আজকে দোয়া করলেন না মানে আমি দোয়া করব না; এমন না। ফরজ নামাজের পরের দোয়া, এটা জামাতের আমল না। একসাথে করলেও আপত্তি নাই, আবার আলাদাভাবে করলে তাতেও আপত্তি নাই।
অনুলিখন : মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক
সহসম্পাদক, বাংলাদেশের খবর


