Logo

খবর

জামিয়া ইসলামিয়া মোমেনশাহী : ইলমে নববীর সবুজ বাগান

Icon

মুহাম্মদ এনায়েত কবীর

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:০৪

জামিয়া ইসলামিয়া মোমেনশাহী : ইলমে নববীর সবুজ বাগান

মোমেনশাহীর ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া। ইলমে নববীর সবুজ কানন। ফুল-ফসলে ভরা। মানুষের মনবাগানে রোপন করছে সততার বৃক্ষ। তাকওয়ার প্রদীপ জেলে দিচ্ছে অগণিত অন্ধ হৃদয়ে। দেশের প্রতিটি জনপদ পাচ্ছে এ বাগানের  সুফল ও সুবাস। ইলমের সৌরভ নিয়ে এখানকার শিক্ষার্থীরা ছুটে যাচ্ছেন সবখানে। জীর্ণ কুটির থেকে উঁচু প্রসাদে, মসজিদের মিম্বার থেকে সবুজ মাঠে, উঁচু মিনার থেকে সাদা সামিয়ানায়, রাজপথ থেকে অন্ধকার অলিগলি, সব জায়গায়।

১৯৯৪ সন। স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানে আমার ‘আলিফ-বা-তা-ছা’র  প্রথম পাঠ। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন পীরে কামেল মাওলানা শরফুদ্দীন রহ.। ইলমে আমলে খুবই উঁচু পর্যায়ের মানুষ তিনি। ছাত্রদের ব্যাপারে কোমলে-কঠোরে হৃদয়বান। পড়াশুনার পাশাপাশি তাকওয়া ও সুন্নতের আলোয় ছাত্রদেরকে আলোকিত করতে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। এখনো জামিয়ার সবুজ বাতাসে কান রাখলে শোনা যায়, তাঁর তাকওয়া এবং দরদমাখা কথাগুলো। তাঁর আগেও এ জামিয়ায় দ্বীন ও দেশের তরে নিবেদিত অনেক মহান সাধকের পদদলি পড়েছে। এখনো জামিয়ার এক মুষ্টি মাটি নাকের কাছে তুলে ধরলে প্রবাদপ্রতিম আলেম ব্যক্তিত্ব আতহার আলী রহ.-এর শ্রম ও ঘামের ঘ্রাণ পাবেন।

এখানকার প্রতিটি বালুকনায় মিশে আছে মাওলানা মিয়া হোসাইন রহ., মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ., মাওলানা আশরাফ আলী রহ.-এর অবদান। এ জামিয়ার মাটি তাঁদের সফেদ আত্মার আলো পেয়েছে বহুদিন। এ জামিয়ার সবুজ ঘাসে পদধূলি পড়েছিল মহান সাধক ব্রিটিশ বিরোধী নির্ভীক সৈনিক মাওলানা আরিফ রব্বানী রহ. এর। এছাড়াও ইলমে নবুওয়াতের ধারক-বাহক রতœতুল্য অগণিত নায়েবে নবীর আলো বাতাস মেখেছে এই জামিয়ার মাটি।

এ প্রতিষ্ঠানের কথা স্মরণ হলে মধুর শৈশবের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। তখন একা একাই হাসি। আমরা মকতব পড়েছি উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ের চার তলায়। নরম মনের মানুষ হাফেজ নুরুল হক ছিলেন আমাদের মকতবের উস্তাদ। একদিন তিনি ‘ফা’ হরফেরর মাখরাজ পড়াচ্ছেন। বুঝাতে গিয়ে এক পর্যায়ে বললেন, ফা উচ্চারনের সময় উপরের দুই দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের হবে। এ কথা শুনে আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। বড় মুশকিলের কথা। দুই দাঁতের ফাক দিয়ে বাতাস বের করব কিভাবে? আমার তো দুই দাঁতের মাঝে কোনো ফাঁক নেই।

তাহলে ‘ফা’-এর উচ্চারণ শেখার উপায় কি? কি করা এখন? তখন মনে একটা উত্তর উদয় হলো। তা এই যে, পুরাতন ছাত্ররা হয়তো মাদরাসার পাশের ময়মনসিংহ মেডিকেলে গিয়ে দাঁতের মাঝে ফাঁক করে নিয়ে আসে। এরপর ‘ফা’- এর উচ্চারণ শিখে। আমারও হয়তো তাই করতে হবে।

এ সমস্যা নিয়ে আমার শ্রদ্ধাভাজন চাচা মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক হাফিজাহুল্লাহুর সাথে কথা বলারও নিয়ত করেছিলাম। কারণ তিনি এই জামিয়ার শিক্ষক এবং মেডিকেল মসজিদের ইমাম। ‘ফা’ নিয়ে এই ফাও বিড়ম্বনার কথা মনে পড়লে এখনো হাসি আসে।

কিন্তু একটা জিনিস খুব সিরিয়াসলি ভাবি। তা হলো, সমাজ এখন সহজ ও আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদানের পরিবেশ চায়। কিন্তু মকতবের অবুঝ শিশুদের অধিকতর সহজ ও আনন্দঘন পদ্ধতিতে মাখরাজ শিখানোর কোনো পদ্ধতি কি সৃষ্টি হয়েছে? নিজস্ব পরিবেশ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মকতবের মন খারাপ একটি শিশুকেও মাখরাজ পড়ানো হয়।

সে ছেলেটি কি হলক বুঝে? বিভিন্ন মাখরাজে রয়েছে ‘তার বরাবর উপরের তালুর সঙ্গে লাগিয়ে’ এ কথাটা প্রথমবার পড়ে মর্ম বুঝেছিলেন আপনি? মনে হয় না। সুতরাং আমার মনে হয় প্রথমে মুখ মুখে হরফের উচ্চারণ শিখিয়ে ধীরে ধীরে মাখরাজের কানুন পড়ালে শিশু বাচ্চাদের জন্য আসান হবে।

তথ্যের অভাবে ছড়ায় গুজব। জ্ঞানের অভাবে তৈরি ভুল কথা। আমদের মকতব ও হেফজ পড়ার সময় একটি ভুল কথা খুব চলতো। তাহলো শিক্ষকের বেতের আঘাতের জায়গা জাহান্নামের আগুনে পুড়বে না। এ কথা শোনার পর ছাত্রদের প্রতি উস্তাদদের কল্যাণকামীতার বিষয়ে খটকা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, উস্তাদদের বেতের আঘাতের স্থান যেহেতু জাহান্নামে পুড়বে না, তাহলে উস্তাদগণ একজন ছাত্রকে ডেকে সারা শরীরে বেতের আঘাত দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেই হয়। বেতের আঘাতের জায়গা যেহেতু জাহান্নামে পুড়বে না সুতরাং তার ঠিকানা তো জান্নাত। শুধু শুধু কেন মকতবে বসে টাইট রুটিন আর অপছন্দের খাবার খেয়ে কষ্ট করতে হবে? উস্তাদরা কেন ছাত্রদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির ব্যাপারে এতটুকু উপকার করছেন না?

মোমেনশাহীর জামিয়া ইসলামিয়া চরপাড়ায় আমি মকতব এবং হিফজ বিভাগে ৬ পারা পড়ি। এরপর ঢাকা চৌধুরীপাড়ার শেখ জনরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদরাসায় ভর্তি হই। খুব মনে পড়ে জামিয়া ইসলামিয়া হেফজ খানার সাথী আব্দুল বাতেন, রুহুল আমিন, কামরুল, মামুন দুই ভাই, বদরুস সাঈদ, ফারকুলিত, অসম্ভব মেধাবী জুনায়েদ, জাবেদ কাওসার ও বশীরদের কথা। তাদের সবাই বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।

জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসার সামনে দিয়েই ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক। বাড়ি থেকে যে বাসে করে আমরা মাদরাসায় আসতাম, সে বাসগুলো কখনো জামিয়ার সামনের সড়কে পার্কিং করতো। জামেয়ার উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ের চারতলা থেকে রাস্তা পরিষ্কার দেখা যেত। সে বাসগুলো দেখে  হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠতো। বাড়ির কথা মনে পড়ে চোখ ছল ছল হয়ে যেত। ‘আহারে! এই বাসে করেই তো বাড়িতে যাই। বাসগুলোতো একটু পরেই বাড়ির দিকে যাবে। কিন্তু আমি যেতে পারছি না।’

এই জামিয়া স্মৃতির অসংখ্য বোঝা বহন করে চলছে। যে জামিয়ায় এক সময় আমি পিতৃতুল্য চাচা আর বড় ভাই মুজিবুর রহমান জাহাঙ্গীরের হাত ধরে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই আমি এখনো সেখানে যাই। তবে শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, বরং শিক্ষার্থীর বাবা হয়ে।

হিফজ বিভাগের সাবেক শিক্ষক ঈশ্বরগঞ্জের শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ সাহেব, গন্ডার আব্দুল আউয়াল সাহেব, ঈশ্বরগঞ্জের কারী আব্দুস সালাম সাহেব, ফুলপুরের আব্দুল বাতেন সাহেব, সোলাইমান সাহেব, নুরুল হক সাহেবদেরকে প্রথম যখন দেখেছিলাম তাঁদের মাথায় ঘন কালো চুল ছিল। চেহারায় যৌবনের উচ্ছলতা ছিল। সেই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণ সময়ের ব্যবধানে এখন বার্ধক্যে চলে গেছেন। মাথায় কাঁচা চুল নয়, বরং পাকা বা আধা পাকা চুলের আধিক্য। চোখে বসেছে চশমা, গায়ের চামরায় ভাজ পড়েছে, নানান অসুখে জর্জরিত। আল¬াহ তাআলা তাঁদেরকে সুস্থ এবং শান্তিতে রাখুন।

যে শিক্ষকদের বেতের আঘাত আমাদেরকে কাঁদিয়েছে, এখন সেই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের কারো কারো জানাজায় দাঁড়িয়ে আমাদের আবারো কাঁদতে হয়। এ কান্না ক্ষমা এবং মাগফিরাতের।

বোর্ডিংয়ের তোতা মিয়ার কথা মনে পড়ে। খাবার টাইমের আগে গেলে টুলে বসে থাকা বিশালদেহী সেই তোতা ভাই কড়া কন্ঠে বলতেন, “এহন বোর্ডিংয়ের গেট খোলা যাইবো না, এহোনো ঘণ্টা পরতে মেলা দেরি আছে। যাইন, পড়তে যাইন।”

আজ সেই বোর্ডিং আছে। কিন্তু তোতা ভাই নেই। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতবাসী করুন।

প্রিয় সেই জামিয়ার অনেক বয়স হয়েছে। বয়স ঢাকতে দেওয়ালগুলো ঘসে-মেজে রং মেরে উজ্জ্বল করা হবে। কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যাবে ঠিক আগের মতোই অমলিন। বহন করবে আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর শৈশব-কৈশোর। 

বহন করবে অনেক শিক্ষক ও কর্মচারীর যৌবন, বার্ধক্য। কারো কারো চিরবিদায়ের সাক্ষী হবে এই জামিয়া। তবে যাই হোক, অগণিত মানুষের হৃদয় আঙ্গিনায় চির উন্নত হয়েই থাকবে ইলমে নববীর আলোকিত মিনার প্রিয় জামিয়া ইসলামিয়া।

লেখক : শিক্ষক, শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসা, ঢাকা-১২১৯

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর