স্মৃতিচারণ
পোকখালী মাদরাসার মুহূর্তগুলো গেঁথে আছে হৃদয়ের গহীনে
মুহাম্মদ হেদায়ত উল্লাহ
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১১
আমার পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল কওমি মাদরাসার পবিত্র পরিবেশে। বাবা নিজেও ছিলেন একজন কওমি আলেম। তাই শৈশব থেকেই দ্বীনি শিক্ষার আবহেই আমার বেড়ে ওঠা। দাওরা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কওমি মাদরাসাতেই অতিবাহিত করেছি। সে সময়টা ছিল সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকদের নেগরানিতে থাকা- দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রিত, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলায় বাঁধা। নামাজ আদায়ে ছিল যথেষ্ট পাবন্দি, যা আমাদের জীবনবোধ ও চরিত্র গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
২০১৫ সালে আমি পড়াশোনা করি আল-জামিয়া আল-ইমদাদিয়া আযিযুল উলুম পোকখালী মাদরাসায়, জামাতে ছাহারুম (শরহে জামি)। মাদরাসাটির শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত ও কঠোর। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় এ মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্ট ছিল প্রায় নিশ্চিত। বিশেষ করে নাহু-সরফের ওপর এখানে দেওয়া হতো বিশেষ গুরুত্ব। নাহু সরফের ইজারা বা নিয়মিত চর্চা ছিল প্রচুর। বছরের শুরুতেই নাহু, সরফ ও তারকিবের ওপর আলাদা আলাদা মুনাজারা অনুষ্ঠিত হতো। এই মুনাজারাগুলো ছিল অসাধারণ- শেখার জন্য যেমন কার্যকর, তেমনি উপভোগ্যও।
কক্সবাজার জেলার ঈদগাহ উপজেলার পোকখালী গ্রামে অবস্থিত এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মাওলানা মুখতার আহমদ (রহ.)। তাঁর কাছে আমরা তরজমাতুল কোরআন পড়তাম। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহীভাবে পাঠদান করতেন। তিনি ছিলেন আল্লামা ইকবালের একনিষ্ঠ ভক্ত। ক্লাসে প্রায়ই ইকবালের শের ফার্সি ভাষায় আবৃত্তি করতেন, এরপর তার বাংলা অনুবাদ কবিতার ছন্দে বুঝিয়ে দিতেন। হুজুরের ক্লাস ছিল সত্যিই দারুণ উপভোগ্য- আজও সেই মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে ভাসে।
পোকখালীর সব শিক্ষকই ছিলেন যথেষ্ট ইলমদার ও কঠোর পরিশ্রমী। সেখানে যেন রাতদিন শুধু পড়া আর পড়া। অবকাশ বলতেই তেমন কিছু ছিল না। আসরের পর ছাড়া আর কোনো সময় আমাদের অবকাশ মিলত না। সেই সামান্য সময়টুকুও মূলত রাতের ভাত খাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল। রাতে ভাত খাওয়ার অনুমতি ছিল না। কারণ, ভাত খেতে গেলে সময় নষ্ট হবে, আর সময় নষ্ট হলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে- এই ছিল নীতিমালা। তাই আসরের পরই মাদরাসার মাতবাখ (রান্নাঘর) থেকে ভাত এনে দ্রুত খেয়ে নিতে হতো।
ছুটি বলতে কার্যত কিছুই ছিল না। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম- আমি আর আমার খালাতো ভাই কফিল সাঈদ (মায়ের ফুফাতো বোনের ছেলে)। একদিন তার নানি ইন্তেকাল করলে আমরা ছুটির জন্য হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর আমাদের জিজ্ঞেস করলেন,
-‘এখন নানি কোথায়?’
আমরা বললাম, ‘চট্টগ্রাম হাসপাতালে।’
হুজুর বললেন,
-‘হাসপাতাল থেকে তোমাদের বাড়ি মহেশখালীতে আনতে কত সময় লাগতে পারে?’
আমরা বললাম-
-‘প্রায় ৫ ঘণ্টা’
-‘আচ্ছা, তাহলে তো এখনো বাসায় আনা হয়নি। যাও, তোমরা আরেকটু পড়াশোনা করে নাও। তারপর বাসায় গিয়ে জানাযার নামাজ পড়ে আবার রাতে মাদরাসায় চলে আসবে।’
অথচ মাদরাসা থেকে নানির বাসা ছিল প্রায় ৪ ঘণ্টার গাড়ির পথ। তবুও পড়াশোনার ব্যত্যয় যেন না হয়- এই ছিল তাঁদের চিন্তা। তখন হয়তো বিষয়টি কঠিন মনে হয়েছিল, কিন্তু আজ বুঝি, এই কঠোরতার মাঝেই ছিল সময়ের মূল্য বোঝানোর এক অনন্য শিক্ষা।
জুমাবারেও পড়াশোনা বন্ধ থাকত না। জুমার দিন সকাল সাড়ে ৯টায় ছুটি দেওয়া হতো। জুমার নামাজ শেষে আবার তাকরার (গ্রুপ স্টাডিতে) বসতে হতো। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু অদম্য অধ্যবসায়।
পোকখালী মাদরাসার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ। সেখানে কখনো কোনো হুজুরের নাম ধরে ডাকার প্রশ্নই উঠত না। বরং হুজুরদের জন্মস্থান বা গ্রামের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সম্বোধন করা হতো। যেমন- একজন হুজুরের বাড়ি ছিল তুলাতুলি গ্রামে, তাই তাঁকে আমরা ‘তুলাতুলি হুজুর’ নামেই ডাকতাম। এই সম্বোধনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকত গভীর আদব ও সম্মান। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দীর্ঘদিন পড়াশোনা করার পরও অনেক হুজুরের প্রকৃত নাম আমরা জানতাম না এইভাবে গড়ে ওঠা সম্মানবোধ আমাদের চরিত্রে এমনভাবে প্রোথিত হয়েছিল, যা আজও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আচরণে প্রভাব ফেলে।
আজ পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়- এই সময়গুলো শুধু পড়াশোনার স্মৃতি নয়, বরং শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও সময়ানুবর্তিতার এক জীবন্ত পাঠ। পোকখালীর সেই দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে কঠোর, অথচ সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায় হয়ে আজও হৃদয়ে জ্বলজ্বল করে।
লেখক : প্রভাষক ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা, পটুয়াখালী- বরিশাল

