দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যিনি কেরাত শাস্ত্র নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেছেন, তিনি হজরত মাওলানা কারী মো. ইউসুফ (রহ.)। তিনি পাকিস্তানের করাচিতে ১৯৫৭ সালে ইলমে কেরাত বিষয়ে পড়েন এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রাসুল (সা.) থেকে কেরাতের যে ধারাবাহিক সনদ, সেটি অর্জন করেন। আর সনদটি গ্রহণ করেন দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন মুহতামিম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.)-এর হাত থেকে। করাচিতে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তার হাতে সনদের স্মারক তুলে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়; কারী শাকের কাসেমী (রহ.)-এর সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানে সরকারিভাবে সর্বপ্রথম কারী হিসেবেও স্বীকৃতি পান তিনি। ১৯৬০ সালে করাচি বেতারে যোগদান করেন। এবং তার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের সরকারি টেলিভিশন পিটিভির সম্প্রচার চালু হয়। ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের পক্ষে উপমহাদেশে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২য় স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এভাবেই চলতে থাকে তার কোরআনের খেদমত। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ, এতে তিনি সংগঠক হিসেবে অনন্য অবদান রাখেন। এ অভিযোগে তাকে পিটিভি ও করাচি বেতার থেকে চাকরিচ্যুত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি লুকিয়ে করাচি থেকে কলম্বো হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশেরও মুখ্য কারীর মর্যাদা পান। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং বিটিভি ও বেতারের অনুষ্ঠান তার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই শুরু হতো। একই সঙ্গে তার কোরআনের ধারাবাহিক খেদমতও জারি রাখেন এবং স্বাধীনতার পর ১৯৯১ সালে পল্টন ময়দানে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কেরাত সম্মেলনের গোড়াপত্তন করেন। কেরাত যে ইসলামি শিক্ষার স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র, বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়টিও জানেন তার মাধ্যমেই। প্রথমে পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের হয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ সফর করেন এবং দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন। ১৯৭৯ সালে সৌদি বাদশাহর রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পবিত্র কাবাঘরে প্রবেশ করার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন। সৌদি জাতীয় টিভি ও বেতারে তিলাওয়াত করেন এবং বাদশাহ কর্তৃক কাবার গিলাফের টুকরো উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। পবিত্র কোরআনের মহান এই খাদেমরই সন্তান বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বরেণ্য কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। কীর্তি এবং অনন্যতায় বহু দিক থেকে যিনি তার বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
মাওলানা কারী মো. ইউসুফ (রহ.) । ছবি : সংগৃহীত
তার যেসব অনন্য কীর্তি
বাবার স্বপ্ন ছিল কেরাতের ময়দানে আহমাদ ইউসুফ অনন্য হয়ে গড়ে উঠবে এবং বাবার পরবর্তী এ জগতের হাল ধরবে। সে লক্ষ্যে তিনি নিজ হাতে সন্তানকে তালিম দিয়ে কারী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং আরও উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ২০০২ সালে মিসরের বিশ্বখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাআহাদুল কেরাতে প্রেরণ করেন। মাআহাদের পাশাপাশি মিসরের তৎকালীন বিশ্বখ্যাত কারীদের নিকট তালিম গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন শায়খদের থেকে থেকে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশুদ্ধ যে ১০টি মুতাওয়াতির (ধারাবাহিক সনদ বিশিষ্ট) কেরাত রয়েছে, সেগুলোর সনদ অর্জন করেন। কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারীর মতে- তার আগে উপমহাদেশের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ কেরাতের সনদ অর্জন করেননি। তবে প্রসিদ্ধ যে ৭টি কেরাত (কেরাতে সাবআ), সেগুলোর সনদ ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একাধিক কারীর ছিল।
একাধিকবার ৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ড
২০০৯ সালে মিসর থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার পর তিনিও বাবার পথ অনুসরণ করে, কোরআনের বহুমুখী খিদমতে মনোযোগী হন এবং একই সঙ্গে শায়খ আযহারীর স্বপ্ন ছিল তার অর্জিত ১০টি কেরাতেই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ড করা। এরই অংশ হিসেবে ২০০৯-২০১০ সালে স্যাটেলাইট টেলিভিশন মাই টিভিতে ৩টি ভিন্ন ভিন্ন সনদে তিনবার পূর্ণ কোরআনুল কাররিমের ৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ড করেন। পরিভাষায় সেই তিনটি রিওয়ায়েত ‘রিওয়ায়েতে ক্বলূন ও ‘রিওয়ায়েতে ওয়ারশ আন নাফে’ এবং রিওয়ায়েতে বাজ্জি আন ইবনে কাসীর’ নামে পরিচিত। তারপর ২০১৪ সালে চ্যানেল আইতে পবিত্র রমজান মাসে সেহরিপূর্ব অনুষ্ঠানের জন্য এবং ২০২১-২০২২ সালে বৈশাখি টিভিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত যে কেরাত ‘রিওয়ায়েতে হাফস’ সম্পূর্ণ ৩০ পারা রেকর্ড করেন। অর্থাৎ প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে মোট পাঁচবার বাংলাদেশের জাতীয় টিভি চ্যানেলে পূর্ণ ৩০ পারা কোরআনুল কারিমের তিলাওয়াত রেকর্ড করেন।
৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ডে আরও বড় স্বপ্ন মিসরের বিখ্যাত কারীদের অন্যতম, যেমন- শায়খ মাহমুদ খলিল হুসারী, শায়খ আব্দুল বাসিত আব্দুস সামাদের মতো আরও মনীষীগণ প্রত্যেকে দুইটি-তিনটির বেশি রিওয়ায়েতের কেরাত রেকর্ড করে যেতে পারেননি। কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী জানিয়েছেন, ‘তিনি এই অসাধ্যকে সাধন করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। তার বাবার স্বপ্ন পূরণে ১০টি কেরাতের সর্বমোট ২০টি রিওয়ায়েতেই তিনি পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ড করতে চান। কারণ, টিভি চ্যানেলগুলোতে করা রেকর্ডের স্বত্ব যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলোর, এজন্য তিনি ফের নতুনভাবে কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ডের যাত্রা শুরু করেছেন, যাতে তিলাওয়াতগুলোর স্বত্ব তার কাছেই থাকে এবং এরই মধ্যে নিজের বাসাতেই স্টুডিও বানিয়ে একটি খতমের রেকর্ড সম্পন্ন করেছেন। ইতোমধ্যে তার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল Qari Yusuf Quran TV তে তা প্রচার শুরু হয়েছে। এই কেরাতটিতে ‘ক্বলূন আন নাফে'র রিওয়ায়েত অনুসরণ করা হয়েছে।
কারী হিসেবে বৈশ্বিক মর্যাদা
২০০৯ সালে দেশে ফেরার পর শায়খ আযহারী বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দেশের জন্য এমন সব সম্মান অর্জন করেছেন, যা উপমহাদেশের একজন মানুষের জন্য কল্পনাতীত। দেশে ফিরে এসে ২০১১ সালের মে মাসে প্রতিযোগী হিসেবে দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন, একই বছর জুনে ইরানে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় কেরাত বিভাগের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তার ফাইনালের তিলাওয়াতটি সারা বিশ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীদের চাইতেও বেশি সমাদৃত হয় এবং তাকে বিশ্বপরিচিতি এনে দেয়। অতঃপর ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ময়দানে তার ভূমিকা বদলে যায়, ওই বছর তানজানিয়াতে অনুষ্ঠিত ইস্ট আফ্রিকা কোরআন প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসন লাভ করেন। ইরানের সেই কোরআন প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আসরসহ বিশ্বের বড় বড় আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন ও কেরাত প্রতিযোগিতায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন।তুর্কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কারী আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী । ছবি : সংগৃহীত
বিগত এক যুগেরও বেশি তার কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের সুমধুর সূর শ্রবণ করে মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রপ্রধানগণ। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো মরক্কোর বাদশাহর আমন্ত্রণে দেশটির রাজপ্রাসাদে কোরআন তিলাওয়াত করেন। প্রতিবছর রমজানে এ অনুষ্ঠানে এখনো বাদশাহ মুহাম্মাদের (ষষ্ঠ) নিয়মিত অতিথি আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ২০১৭ ও ২০২৪ সালে জর্ডানের বাদশাহর দাওয়াতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে জর্ডান সফর করেন এবং সেখানকার মানুষকে সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াতে মুগ্ধ করেন। ২০১৮ সালে ব্রুনাইয়ের বাদশাহ হাসানাল বলকিয়াহর আমন্ত্রণে রাজকীয় মজলিসে তিলাওয়াত করে সবাইকে মুগ্ধ করেন।
নিউইয়র্কের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের কপি উপহার পান শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ছবি : সংগৃহীত
একই বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের দাওয়াতে তুরস্কে কেরাত পড়েন। তার অন্যতম স্মরণীয় সফর ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির নিউইয়র্ক ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে তার কেরাতে মুগ্ধ হন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। শায়খ আযহারী সেদিন পবিত্র জুমার আজানও দেন। আর নামাজপূর্ব খুতবা প্রদান করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। এ সফরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ উপঢৌকন পান তিনি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বের বরেণ্য কারীদের সঙ্গে ইরানের সবোর্চ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এখানে উপস্থিত আছেন শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ছবি : সংগৃহীত
এ ছাড়াও তিনি কানাডা, ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়াসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে বহুবার পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শোনানোর জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়- কেরাতের জগতে উপমহাদেশে তিনি অনন্য।
দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যিনি কেরাত শাস্ত্র নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেছেন, তিনি হজরত মাওলানা কারী মো. ইউসুফ (রহ.)। তিনি পাকিস্তানের করাচিতে ১৯৫৭ সালে ইলমে কেরাত বিষয়ে পড়েন এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে রাসুল (সা.) থেকে কেরাতের যে ধারাবাহিক সনদ, সেটি অর্জন করেন। আর সনদটি গ্রহণ করেন দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন মুহতামিম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.)-এর হাত থেকে। করাচিতে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তার হাতে সনদের স্মারক তুলে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়; কারী শাকের কাসেমী (রহ.)-এর সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানে সরকারিভাবে সর্বপ্রথম কারী হিসেবেও স্বীকৃতি পান তিনি। ১৯৬০ সালে করাচি বেতারে যোগদান করেন। এবং তার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের সরকারি টেলিভিশন পিটিভির সম্প্রচার চালু হয়। ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের পক্ষে উপমহাদেশে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২য় স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এভাবেই চলতে থাকে তার কোরআনের খেদমত। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ, এতে তিনি সংগঠক হিসেবে অনন্য অবদান রাখেন। এ অভিযোগে তাকে পিটিভি ও করাচি বেতার থেকে চাকরিচ্যুত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি লুকিয়ে করাচি থেকে কলম্বো হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশেরও মুখ্য কারীর মর্যাদা পান। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং বিটিভি ও বেতারের অনুষ্ঠান তার তিলাওয়াতের মাধ্যমেই শুরু হতো। একই সঙ্গে তার কোরআনের ধারাবাহিক খেদমতও জারি রাখেন এবং স্বাধীনতার পর ১৯৯১ সালে পল্টন ময়দানে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কেরাত সম্মেলনের গোড়াপত্তন করেন। কেরাত যে ইসলামি শিক্ষার স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র, বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়টিও জানেন তার মাধ্যমেই। প্রথমে পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের হয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ সফর করেন এবং দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনেন। ১৯৭৯ সালে সৌদি বাদশাহর রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পবিত্র কাবাঘরে প্রবেশ করার বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন। সৌদি জাতীয় টিভি ও বেতারে তিলাওয়াত করেন এবং বাদশাহ কর্তৃক কাবার গিলাফের টুকরো উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। পবিত্র কোরআনের মহান এই খাদেমরই সন্তান বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বরেণ্য কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। কীর্তি এবং অনন্যতায় বহু দিক থেকে যিনি তার বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
মাওলানা কারী মো. ইউসুফ (রহ.) । ছবি : সংগৃহীত
তার যেসব অনন্য কীর্তি
বাবার স্বপ্ন ছিল কেরাতের ময়দানে আহমাদ ইউসুফ অনন্য হয়ে গড়ে উঠবে এবং বাবার পরবর্তী এ জগতের হাল ধরবে। সে লক্ষ্যে তিনি নিজ হাতে সন্তানকে তালিম দিয়ে কারী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং আরও উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ২০০২ সালে মিসরের বিশ্বখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাআহাদুল কেরাতে প্রেরণ করেন। মাআহাদের পাশাপাশি মিসরের তৎকালীন বিশ্বখ্যাত কারীদের নিকট তালিম গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন শায়খদের থেকে থেকে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশুদ্ধ যে ১০টি মুতাওয়াতির (ধারাবাহিক সনদ বিশিষ্ট) কেরাত রয়েছে, সেগুলোর সনদ অর্জন করেন। কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারীর মতে- তার আগে উপমহাদেশের কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ কেরাতের সনদ অর্জন করেননি। তবে প্রসিদ্ধ যে ৭টি কেরাত (কেরাতে সাবআ), সেগুলোর সনদ ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একাধিক কারীর ছিল।
একাধিকবার ৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ড
২০০৯ সালে মিসর থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার পর তিনিও বাবার পথ অনুসরণ করে, কোরআনের বহুমুখী খিদমতে মনোযোগী হন এবং একই সঙ্গে শায়খ আযহারীর স্বপ্ন ছিল তার অর্জিত ১০টি কেরাতেই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ড করা। এরই অংশ হিসেবে ২০০৯-২০১০ সালে স্যাটেলাইট টেলিভিশন মাই টিভিতে ৩টি ভিন্ন ভিন্ন সনদে তিনবার পূর্ণ কোরআনুল কাররিমের ৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ড করেন। পরিভাষায় সেই তিনটি রিওয়ায়েত ‘রিওয়ায়েতে ক্বলূন ও ‘রিওয়ায়েতে ওয়ারশ আন নাফে’ এবং রিওয়ায়েতে বাজ্জি আন ইবনে কাসীর’ নামে পরিচিত। তারপর ২০১৪ সালে চ্যানেল আইতে পবিত্র রমজান মাসে সেহরিপূর্ব অনুষ্ঠানের জন্য এবং ২০২১-২০২২ সালে বৈশাখি টিভিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত যে কেরাত ‘রিওয়ায়েতে হাফস’ সম্পূর্ণ ৩০ পারা রেকর্ড করেন। অর্থাৎ প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে মোট পাঁচবার বাংলাদেশের জাতীয় টিভি চ্যানেলে পূর্ণ ৩০ পারা কোরআনুল কারিমের তিলাওয়াত রেকর্ড করেন।
৩০ পারা তিলাওয়াত রেকর্ডে আরও বড় স্বপ্ন মিসরের বিখ্যাত কারীদের অন্যতম, যেমন- শায়খ মাহমুদ খলিল হুসারী, শায়খ আব্দুল বাসিত আব্দুস সামাদের মতো আরও মনীষীগণ প্রত্যেকে দুইটি-তিনটির বেশি রিওয়ায়েতের কেরাত রেকর্ড করে যেতে পারেননি। কারী শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী জানিয়েছেন, ‘তিনি এই অসাধ্যকে সাধন করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। তার বাবার স্বপ্ন পূরণে ১০টি কেরাতের সর্বমোট ২০টি রিওয়ায়েতেই তিনি পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ড করতে চান। কারণ, টিভি চ্যানেলগুলোতে করা রেকর্ডের স্বত্ব যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলোর, এজন্য তিনি ফের নতুনভাবে কোরআন তিলাওয়াত রেকর্ডের যাত্রা শুরু করেছেন, যাতে তিলাওয়াতগুলোর স্বত্ব তার কাছেই থাকে এবং এরই মধ্যে নিজের বাসাতেই স্টুডিও বানিয়ে একটি খতমের রেকর্ড সম্পন্ন করেছেন। ইতোমধ্যে তার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল Qari Yusuf Quran TV তে তা প্রচার শুরু হয়েছে। এই কেরাতটিতে ‘ক্বলূন আন নাফে'র রিওয়ায়েত অনুসরণ করা হয়েছে।
কারী হিসেবে বৈশ্বিক মর্যাদা
২০০৯ সালে দেশে ফেরার পর শায়খ আযহারী বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দেশের জন্য এমন সব সম্মান অর্জন করেছেন, যা উপমহাদেশের একজন মানুষের জন্য কল্পনাতীত। দেশে ফিরে এসে ২০১১ সালের মে মাসে প্রতিযোগী হিসেবে দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান লাভ করেন, একই বছর জুনে ইরানে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় কেরাত বিভাগের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তার ফাইনালের তিলাওয়াতটি সারা বিশ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীদের চাইতেও বেশি সমাদৃত হয় এবং তাকে বিশ্বপরিচিতি এনে দেয়। অতঃপর ২০১২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ময়দানে তার ভূমিকা বদলে যায়, ওই বছর তানজানিয়াতে অনুষ্ঠিত ইস্ট আফ্রিকা কোরআন প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসন লাভ করেন। ইরানের সেই কোরআন প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আসরসহ বিশ্বের বড় বড় আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন ও কেরাত প্রতিযোগিতায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন।তুর্কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কারী আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী । ছবি : সংগৃহীত
বিগত এক যুগেরও বেশি তার কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের সুমধুর সূর শ্রবণ করে মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রপ্রধানগণ। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো মরক্কোর বাদশাহর আমন্ত্রণে দেশটির রাজপ্রাসাদে কোরআন তিলাওয়াত করেন। প্রতিবছর রমজানে এ অনুষ্ঠানে এখনো বাদশাহ মুহাম্মাদের (ষষ্ঠ) নিয়মিত অতিথি আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ২০১৭ ও ২০২৪ সালে জর্ডানের বাদশাহর দাওয়াতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে জর্ডান সফর করেন এবং সেখানকার মানুষকে সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াতে মুগ্ধ করেন। ২০১৮ সালে ব্রুনাইয়ের বাদশাহ হাসানাল বলকিয়াহর আমন্ত্রণে রাজকীয় মজলিসে তিলাওয়াত করে সবাইকে মুগ্ধ করেন।
নিউইয়র্কের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের কপি উপহার পান শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ছবি : সংগৃহীত
একই বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের দাওয়াতে তুরস্কে কেরাত পড়েন। তার অন্যতম স্মরণীয় সফর ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির নিউইয়র্ক ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে তার কেরাতে মুগ্ধ হন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। শায়খ আযহারী সেদিন পবিত্র জুমার আজানও দেন। আর নামাজপূর্ব খুতবা প্রদান করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। এ সফরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ উপঢৌকন পান তিনি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বের বরেণ্য কারীদের সঙ্গে ইরানের সবোর্চ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এখানে উপস্থিত আছেন শায়খ আহমাদ বিন ইউসুফ আযহারী। ছবি : সংগৃহীত
এ ছাড়াও তিনি কানাডা, ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়াসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে বহুবার পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শোনানোর জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়- কেরাতের জগতে উপমহাদেশে তিনি অনন্য।