-683edfbcdf5e3.jpg)
রহমান সাহেব আজ সারাদিন কিছু খেতে পারেননি। শরীরের শক্তি কমে আসছে, মনটা আরও বেশি ক্লান্ত। এই বার্ধক্যে এসে ক্লান্তি শুধু শরীরে না, সেটা ছড়িয়ে আছে আত্মায়, স্মৃতিতে, অতীতের প্রতিটি কোণায়। বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে। সবকিছু যেন হালকা কুয়াশায় ঢাকা। সময়টা পড়ন্ত বিকেল তার জীবনের মতই। রাস্তার ওপারে এক দৃশ্য তাকে থমকে দিল। এক বুড়ো রিকশাওয়ালা, গায়ে মলিন কাপড়, কাঁধে পরিশ্রমের ছাপ, পাশে একটি ছোট্ট ছেলের হাত ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন। ছেলেটির কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, আরবিতে লেখা ‘আলিফ-বা-তা’। রহমান সাহেব চিনে ফেললেন, সে তো কুদ্দুস! একসময়ের সেই রিকশাচালক, যাকে তিনি দেখতেন নীচু চোখে। সেই কুদ্দুস আজও তার শেষ সম্বল, নাতিকে, নিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানের পথে। কিন্তু কেমন এক ভিন্ন জ্ঞান। সে যে পথ প্রগতির বুলি শেখায় না, বরং শেখায় স্রষ্টার কথা, নবীর আদর্শ, আত্মার মুক্তির পথ।
রহমান সাহেবের বুক চেপে আসে। স্মৃতি খুলে যায় হঠাৎ। রহমান সাহেব এক সময়ের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নাম ডাক, সম্মান, শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে ছড়িয়েছেন প্রগতির আলো। ক্লাস রুমে দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন ‘ধর্ম মানুষের কল্পনায় তৈরি এক সীমাবদ্ধতা, বিজ্ঞানই একমাত্র মুক্তির পথ।’ যুক্তিতে মুক্তি খোঁজা রহমান সাহেব কখনো এই যুক্তি খোঁজেননি সূর্য পূর্ব দিকে না উঠে পশ্চিম দিকে কেনো ওঠে না? খোদা কে দেখা যায় না তাই কল্পনা। তাহলে অক্সিজেন কে আমরা না দেখে কেন বিশ্বাস করি? আর কেনই বা কুকুরের রেটিনা যা দেখতে পারে তা মানুষের রেটিনা দেখতে পায় না?
তিনি তো ছেলেকে দিয়েছিলেন গিটার বাজাতে। বলেছিলেন ‘তুমি বিজ্ঞান পড়ো, ধর্মের পেছনে সময় নষ্ট করো না।’ অথচ প্রগতিশীল ছেলের গতকালের ফোনে কথা বলা থেকে বুঝলেন, যতটুকু আদর সোহাগ পাচ্ছেন তা উনার পেনশনের টাকার লোভে আর সঞ্চয়পত্রের সুদের বদৌলতে। ছেলের বউও বেয়াদবির চর্চায় ব্যস্ত। মেয়েকে বলেছিলেন ‘তুমি যেন মুসলিম মেয়েদের মতো না হও। তোমার স্বাধীনতা আছে, তোমার শরীর, তোমার ইচ্ছা।’ নিজের স্ত্রী মেয়েকে পর্দা নয়, নির্লজ্জ বেহায়ার মত দেখতে পেলে খুঁজে পেতেন এক অজানা সুখ, নিজেকে ভাবতেন প্রগতিশীল মানুষ।
কোরানের বদলে তার লাইব্রেরিতে ছিল দার্শনিকদের বই, নাস্তিকদের তর্ক, পশ্চিমা গবেষণার অনুবাদ। যে কোরান নিয়ে এত প্রশ্ন, অথচ এই কোরান কোনো দিন খুলেই দেখেনি। অর্থসহ কোনোদিন পড়ে দেখেননি। তার প্রিয় উক্তি ছিল ‘ধর্ম মানুষকে পশ্চাৎপদ করে। কোরান এখন আর ব্যবহারিক না। আমাদের দরকার বিজ্ঞান, যুক্তি আর মানবতা!’ তিনি এই বিশ্বাসে পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে বিজ্ঞান তিনি পুজো করেছেন, সে তাকে শান্তি দেয়নি। যে যুক্তি তিনি বানিয়েছেন, সে তাকে ছেলেমেয়ের ভালোবাসা দিতে পারেনি। আর যে মানবতা তিনি মুখস্থ করেছিলেন, তা তাকে ঠাঁই দিয়েছে একটি বৃদ্ধাশ্রমের শীতল বারান্দায়।
আজ তিনি একা। অত্যন্ত নিঃসঙ্গ। তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কি সত্যিই শিক্ষিত ছিলাম? নাকি শিক্ষিত থাকার অহংকারে আমি সব জ্ঞান হারিয়েছি?’ তিনি বুঝতে পারেন তিনি যে ‘প্রগতি’র কথা বলতেন, সেটা ছিল নিজের বানানো একটি দেয়াল। সেই দেয়ালের বাইরে ছিল স্রষ্টার সত্য, নবীর আদর্শ, আর মানুষের আসল উদ্দেশ্য। তিনি বুঝতে পারেন যে কুদ্দুসকে তিনি ছোট মনে করতেন, সে-ই হয়ত সফল। কারণ সে তার উত্তরসূরিকে সেই পথে নিয়ে যাচ্ছে, যে পথ স্রষ্টার দিকে ফেরায়।
রহমান সাহেবের মুখটা আজ নত, না বয়সের ভারে নয়, বরং অনুতাপের ভারে। রহমান সাহেব চোখ বন্ধ করেন। বুকের ভেতর এক বিষাদের ঢেউ উঠে আসে। মনে হয়, তার সারাজীবনের ‘জ্ঞান’ যেন কিছুতেই পারছে না কুদ্দুসের সেই ছেলেটির হাতে ধরা কোরানের ওজনে ভারসাম্য রাখতে।
রহমান সাহেবের মত হাজারো মানুষ আজ বৃদ্ধাশ্রমে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একাকী, ক্লান্ত মায়ের কান্না জড়ানো মুখ। অম্লান, নিষ্প্রভ বাবা মায়ের দৃষ্টি যেন প্রশ্ন তোলে ‘সারাজীবন কীসের জন্য করলাম এই সংগ্রাম?’ এ যেন জীবনের সবচেয়ে নির্মম পরিণতি, যেখানে স্বজন বলতে কিছু নেই, সন্তান আছে শুধু স্মৃতিতে। যে সন্তানকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন, রাতে জেগে অসুস্থতার পাশে বসে থেকেছেন, তারাই আজ হয়ত ফোন ধরতে ব্যস্ত, কিংবা সময় নেই বলে মায়ের মুখটাও দেখতে আসেন না মাসের পর মাস।
আজকের সমাজে আমরা যে করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি, তা হলো সন্তানের জন্য জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে বৃদ্ধ মা-বাবা শেষ বয়সে স্থান পান বৃদ্ধাশ্রমে, একটি নির্জন ঘরে। সেই সন্তানরই একদিন যাকে ‘আম্মু’, ‘আব্বু’ বলে ডেকেছিল, আজ সে-ই ভাবে ‘মা-বাবা শুধুই বাড়তি বোঝা। রিটার্ন নাই, শুধুই খরচ’।
এই অমানবিক রূপান্তর কি শুধু সন্তানের হৃদয়হীনতার ফল? না কি এর পেছনে লুকিয়ে আছে একটি গোটা প্রজন্মকে ইসলামি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার ভয়াবহ কুফল?
‘ধর্ম ব্যক্তিগত, কিন্তু তার প্রভাব সামষ্টিক’—এই কথাটি যতটা গভীর, ততটাই প্রাসঙ্গিক আজকের বাংলাদেশে। এক সময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্ম ছিল নৈতিকতার অবিচ্ছেদ্য উপাদান। আজ, সেই ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা হ্রাস পাওয়ায় সমাজে নেমে এসেছে এক ধরনের অস্থিরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মানবিকতার সংকট।
এই ধর্মহীনতা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ নয় বরং এটা হল বিশ্বাসহীনতা, আত্মা থেকে নৈতিকতার বিচ্যুতি। আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে সন্তানকে বড় করার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘প্র্যাকটিক্যাল হও, ইমোশনাল হলে টিকতে পারবে না, লাভ-লস বুঝে চলো।’ অথচ তারা শেখে না, নবীজি (সা.) বলেছেন ‘তোমার জান্নাত রয়েছে তোমার মায়ের পায়ের নিচে।’ (সুনান নাসায়ী)।
পরিসংখ্যান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে বৃদ্ধাশ্রমে যেসব মা-বাবা আজ দিন কাটান, তাদের অধিকাংশই শহুরে পরিবারের শিক্ষিত সন্তানদের বাবা-মা। অথচ জীবনের মৌলিক শিক্ষা ‘মানবিকতা’, ‘কৃতজ্ঞতা’, ‘ধর্মীয় দায়িত্ববোধ’ তাদের ছিল না। ইসলামিক শিক্ষা যার হৃদয়ে গেঁথে আছে, সে কখনোই নিজের মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারে না। কারণ সে জানে “তুমি যদি তাদের (মা-বাবা) একজন বা উভয়কেই বৃদ্ধ অবস্থায় পাও, তাহলে তাদের ‘উফ্’ পর্যন্ত বলো না” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ২৩)।
শুধু তাই নয়, একজন ইসলামিক মানুষ জানে মা-বাবার দোয়া পৃথিবীর সব থেকে বড় আশীর্বাদ, আর তাদের অভিশাপ জাহান্নামের আগুন হয়ে যেতে পারে।
আমরা সন্তানকে দিয়েছি আধুনিক শিক্ষা, চমকদার ডিগ্রি, বিদেশে উচ্চশিক্ষা, ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি, আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি তাকে শেখাতে আল্লাহর ভয়, রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ, মা-বাবার অধিকার। আমরা বলেছি, ‘তুমি মানুষ হও বড়’ কিন্তু মানুষ কাকে বলে, তা শেখাইনি। আমরা বলেছি, ‘নম্বর চাই, ক্যারিয়ার চাই’, কিন্তু বলিনি ‘জান্নাত চাই, আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই।’
এই খালি মূল্যবোধই তৈরি করেছে এক শীতল হৃদয়ের প্রজন্ম, যারা ক্যালকুলেটরে হিসাব কষে দেখে মা-বাবার ওষুধ খরচ কত, কেয়ারগিভারের বেতন কত, বৃদ্ধাশ্রমে থাকলে সাশ্রয় হবে কিনা। আর ঠিক এই হিসেব করতেই তারা ভুলে যায় সেই মা-বাবার অসীম ত্যাগ, যারা নিজের খাবার না খেয়ে তাদের মুখে তুলে দিয়েছে একমুঠো ভাত।
কিন্তু সন্তানের এই অধঃপতনের জন্য কে দায়ী? সন্তান নিজে? না দায়ী সেই পরিবারের পিতা বা মাতা যারা দুনিয়ার লোভে নিজ স্বার্থে ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। কেননা ধর্ম ব্যাংকের সুদ খেতে নিষেধ করে, মেয়েকে উত্তমরূপে বিয়ে দেওয়ার কথা বলে, ছেলে-মেয়েকে প্রডাক্ট হিসেবে না দেখে আল্লাহর আমানত হিসেবে দেখতে বলে। ছেলে-মেয়ে আর্থিক সফলতা দিতে পারলে সুসন্তান আর দিতে না পারলে লস প্রজেক্ট হিসেবে মূল্যায়ন—কি প্রধান কারণ?
এমনও পরিবার রয়েছে, যেখানে ছেলে বা মেয়ে নিজ উদ্যোগে বন্ধু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্ম বিষয়ে পড়া শুরু করার পর পরিবারের চাপে পরিবারে মিথ্যা প্রগতিশীলতা চর্চা ধরে রাখতে মাতা বা পিতার চাপ প্রয়োগের ফলে সন্তান এখন পাগলপ্রায়।
না দায়ী সেই সমাজ, যারা দ্বিনি শিক্ষা বাদ দিয়ে ‘সফলতা’র সংজ্ঞা বানিয়েছে কেবল টাকা আর চাকরি?
আজ সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—বৃদ্ধাশ্রম কি সত্যিই প্রয়োজন, নাকি এটা আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি?
নাকি তথাকথিত প্রগতিশীল মাতাপিতার অবিনশ্বর দুনিয়ার যাত্রা শুরু হল নশ্বর এই বৃদ্ধাশ্রম নামক নরক থেকে!!
লেখক : কর আইনজীবী, কলামিস্ট
এমএইচএস