Logo

ধর্ম

কোরবানি : ত্যাগের মহিমা ও সমাজচিত্রের আয়না

Icon

হাফিজ আবুল বাশার

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ২১:৪১

কোরবানি : ত্যাগের মহিমা ও সমাজচিত্রের আয়না

বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ বা ঈদ-উল-আজহা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি এক মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এই দিনটি মুসলিম সমাজের জন্য যেমন আত্মশুদ্ধির প্রতীক, তেমনি এটি হয়ে উঠেছে একটি সামাজিক বিন্যাসের অংশ—যেখানে ত্যাগ, সমবেদনা ও শ্রদ্ধাবোধের গভীর প্রতিফলন দেখা যায়। তবে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যে বাস্তবতা গড়ে উঠেছে, তা কখনো প্রশংসার, আবার কখনো সমালোচনার দাবিদার।

কোরবানির ধর্মীয় তাৎপর্য
কোরবানির শিকড় ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের গভীরে—হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছিলেন একটি পশু। এই ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের ঘটনাই ইসলামে কোরবানির ভিত্তি স্থাপন করে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পশুর মাংস বা রক্ত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া’ (সুরা হজ : ৩৭)।

এই আয়াত থেকেই স্পষ্ট, কোরবানির মূল লক্ষ্য আল্লাহর প্রতি ভক্তি, আনুগত্য এবং আত্মত্যাগের মনোভাব পোষণ করা।

সমাজে কোরবানির প্রভাব
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ একদিকে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের একটি উপলক্ষ হলেও, অন্যদিকে এটি সামাজিক পুনর্বণ্টনের একটি অসাধারণ ব্যবস্থা। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানি হয় এবং এর একটি বিশাল গরিব ও দুস্থ মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এমন বহু পরিবার আছে, যারা সারা বছরে একবার মাত্র ঈদের সময় মাংস খেতে পারে।

এ ছাড়া কসাই, গরু ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, পরিবহনকর্মী, পশুর খাদ্য বিক্রেতা, এবং হাড়-মাংস সংগ্রাহকের মতো অগণিত মানুষ এই কোররবানিকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মযোগে যুক্ত হয়। ফলে এটি একটি ‘সাময়িক অর্থনৈতিক চক্র’ তৈরি করে, যা নিচু আয়ের মানুষের জীবনে তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দেয়।

সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কিছু বাস্তবধর্মী প্রশ্নও সামনে আসে। যেমন—
১. অতিরিক্ত প্রদর্শন : অনেক সময় কোরবানি হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সামর্থ্যের অহংকার প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবে। বড় গরু, বিশেষ জাতের পশু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, যা কোরবানির আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যকে আড়াল করে দেয়।

২. পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি : শহরাঞ্চলে যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় রক্ত ও বর্জ্য পরিষ্কারে সংকট দেখা দেয়। অনেক জায়গায় ড্রেন, রাস্তাঘাট ভরে ওঠে দুর্গন্ধ ও আবর্জনায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

৩. অবিচারমূলক বণ্টন : অনেক সময় কুরবানির মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে গরিবদের মধ্যে সমতা থাকে না। রাজনৈতিক প্রভাব, আত্মীয়প্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্বের কারণে প্রকৃত প্রাপকেরা বঞ্চিত হন।

কোরবানির অন্তর্নিহিত শিক্ষা
কোরবানি কেবল ছুরি চালানো নয়, বরং নিজেকে কাটার অনুশীলন। আমাদের সমাজে অহংকার, হিংসা, হিংস্রতা, লোভ এবং আত্মকেন্দ্রিকতা—এই ‘অদৃশ্য পশুগুলো’ প্রতিনিয়ত বড় হয়ে ওঠে। ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা হলো এই পশুগুলোকে চিনে নেওয়া এবং ঈমানের ধারালো ছুরিতে কেটে ফেলা।

উপসংহার
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ একদিকে ত্যাগের প্রতীক, অন্যদিকে তা সামাজিক সহমর্মিতার এক চিত্রপট। আমাদের প্রয়োজন এর গভীরতম তাৎপর্য উপলব্ধি করা এবং কোরবানিকে কেবল উৎসবে সীমাবদ্ধ না রেখে আত্মশুদ্ধির পথে রূপান্তরিত করা।

যদি আমরা সত্যিকার অর্থে কোরবানির শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করি, তবে ঈদের পরেও সমাজে সাম্য, সহানুভূতি ও মানবিকতা বেঁচে থাকবে—নিঃশব্দে, নিরন্তর।

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলুম কানাইঘাট, সিলেট।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ঈদুল আজহা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর